রাজধানীর পুরানা পল্টন ও জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ঐতিহাসিক মুক্তাঙ্গনে নির্মাণ করা হচ্ছে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) বা ময়লা-আবর্জনা রাখার কেন্দ্র। সেখানে এই আবর্জনা কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে  ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক এই মুক্তাঙ্গনে ময়লা রাখার স্থান বা এসটিএস নির্মাণ করার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন অনেকে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো মুক্তাঙ্গন দখল অবস্থায় রয়েছে। বারবার এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বর্তমানে মাইক্রোবাস ও কার মালিক সমিতি জায়গাটি দখল করে এখানে রেন্ট-এ-কার সার্ভিসের ব্যবসা চালাচ্ছে।

পাশেই রাখা আছে ময়লা-আবর্জনার দুটি কন্টেইনার। বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্যানে বর্জ্য এনে এখানে জমা করা হচ্ছে। তার ঠিক পাশেই টিন দিয়ে ঘিরে এসএটিএস নির্মাণের কাজ চলছে। ভেতরে ইতোমধ্যে পিলারসহ বাউন্ডারি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ শ্রমিকরা বাকি কাজ সম্পন্ন করছেন।

আবর্জনা কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে  ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

জানা গেছে, এ সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনটি (এসটিএস) দৈর্ঘ্যে হবে ৬০ ফুট এবং প্রস্থে হবে ৬০ ফুট। আর এর উচ্চতা হবে প্রায় ২২ ফুট। আগামী মাসের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

মুক্তাঙ্গনের ফাঁকা স্থানে শিশুদের জন্য রাইডস বসানোর জন্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার একটি কর্মপরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে ডিএসসিসি। প্রতিটি ওয়ার্ডে এসটিএস নির্মাণ এবং শিশুদের জন্য উন্মুক্ত খেলার জায়গা নির্মাণের উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এখানে এসব নির্মাণ করা হচ্ছে।

আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মুক্তাঙ্গনের সেই প্রাণচাঞ্চল্য এখন আর নেই। এখন এখানে হয় না কোনো রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ বা মিছিল। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী এ মুক্তাঙ্গন ঐতিহ্য বহন করে এখনও। এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানে সিটি করপোরেশনের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণের বিষয়টি মানতে পারছেন না সচেতন নাগরিকেরা।

মাইক্রোবাস ও কার মালিক সমিতি মুক্তাঙ্গনের জায়গাটি দখল করে রেন্ট-এ-কার সার্ভিসের ব্যবসা চালাচ্ছে

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের বিষয়টির সমালোচনা করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তাঙ্গনটি মুক্তাঙ্গন হিসেবেই থাকা উচিত। এখানে আর একটু সৌন্দর্যবর্ধন এবং কিছু গাছ লাগিয়ে দিলে এই জায়গা আরও সুন্দর হবে। সেখানে মানুষ বক্তৃতা করবে, মানববন্ধন করবে, সভা সমাবেশ করবে। যদি মুক্তাঙ্গনকে মুক্ত রেখে সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়, তবে এটিই খুব ভালো সিদ্ধান্ত হবে। এসটিএস নির্মাণ কোনোভাবেই উচিত হবে না। কারণ এটি ঐতিহাসিক একটি জায়গা। ফাঁকা জায়গায় রাইড স্থাপনের পর শিশুরা যদি সেখানে খেলাধুলা করে, তাহলে পাশে আবর্জনার এসটিএসের কারণে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়তে পারে। তাই আমি মনে করি, মুক্তাঙ্গনে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন না করাই ভালো।

এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তাঙ্গন ঐতিহাসিক জায়গা, রাজনৈতিকভাবেও অনেক গুরুত্ব বহন করে এটি। ঐতিহাসিক এই জায়গাটি ছাড়া দাবি আদায়, জনসভা, মিটিং করার মতো আর কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। সেই জায়গায় ময়লার এসটিএস নির্মাণ করা আসলেই উচিত হবে না। এছাড়া পাশেই সচিবালয়, এখানে যদি আবর্জনার জন্য এসটিএস নির্মাণ করা হয় তাহলে খুবই খারাপ দেখাবে বিষয়টি।

মুক্তাঙ্গনের অবস্থান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এনামুল হক ডিএসসিসির এসটিএস নির্মাণ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেই এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমার ওয়ার্ডেও মুক্তাঙ্গনে এবং মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ দরকার। আমার ওয়ার্ডে এমন কোনো জায়গা ফাঁকা নেই, ফাঁকা বলতে এই মুক্তাঙ্গনই আছে। তাই এখানে রাইড বসানোসহ শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

মুক্তাঙ্গনের পাশেই সচিবালয়

তিনি বলেন, বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার পরও অসাধুরা নানাভাবে বারবার মুক্তাঙ্গন দখল করে নেন। তবে আমাদের কাজ এগিয়ে গেলে এমনিতেই দখলমুক্ত হয়ে যাবে। এসটিএস এর কাজ চলমান রয়েছে, আর শিশুদের খেলার জায়গার জন্য শিগগিরই টেন্ডার দেওয়া হবে। এরপরই কাজ শুরু হয়ে যাবে।

ঐতিহাসিক মুক্তাঙ্গনে আবর্জনা রাখার স্থান বা এসটিএস নির্মাণের বিষয়ে সমালোচনার বিষয়টি উল্লেখ করলে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর বলেন, মুক্তাঙ্গনের এক পাশে এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি জায়গা তো ফাঁকাই থাকবে। যদি কোনো সংগঠন চায় এখানে জনসভা, সমাবেশ করবে তাহলে তা করতে পারবে। মাঠ তো থাকছেই, ফলে ঐতিহাসিক জায়গা খালিই থেকে যাচ্ছে। তাই সমস্যা বা সমালোচনা করার কোনো বিষয় নেই।

ঐতিহাসিক মুক্তাঙ্গনেই কেন এসটিএস নির্মাণ করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করতে আমাদের জায়গা তো লাগবে? এতদিন মুক্তাঙ্গন দখল অবস্থায় ছিল, তখন কোনো সমালোচনা ছিল না, কেউ কোন কথা বলতেন না, সেটা ব্যবহারও করতে পারতেন না। কিন্তু আমরা সেই জায়গা দখলমুক্ত করে একপাশে খেলাধুলার জায়গা আর অন্যপাশে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এসটিএস নির্মাণ করছি। আর তখন সমালোচনার ঝড় বইছে? তিনি বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্যই মুক্তাঙ্গনের একপাশে এসটিএস অন্যপাশে ফাঁকা জায়গায় শিশুদের খেলাধুলার জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্বাধীনতার আগে প্রায় ৮৪ শতাংশ জমির ওপর মুক্তাঙ্গন পার্কটি গড়ে ওঠে। পার্কটি ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে মুক্তাঙ্গন পার্কে নিয়মিত সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। এরপর থেকেই পার্কটিতে দখল শুরু হয়। রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীরা পার্কটির একাংশ দখল করে নেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় ১০ থেকে ১২ বার এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। কিন্তু এখনো এটি দখলমুক্ত করতে পারেনি। তারা আশা করছে, এসটিএস নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এটি ব্যবহার শুরু হলে এবং শিশুদের খেলাধুলার জন্য রাইড স্থাপন হলে এটি দখলমুক্ত হয়ে যাবে।

এএসএস/আরএইচ/জেএস/এমএইচএস