স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে বছরে দরিদ্র হয় ৬০ লাখ মানুষ
বাজেটে কম বরাদ্দ ও ব্যক্তির খরচ বেশি হওয়ায় আমাদের দেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ (জনসংখ্যার প্রায় ৩.৮ শতাংশ) প্রতিবছর শুধু স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বর্তমান করােনা মহামারির কষাঘাতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও জানানো হয়েছে।
বুধবার (৯ জুন) বেলা ১১টায় ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের আয়োজনে জাতীয় বাজেটঃ প্রেক্ষিত- স্বাস্থ্য ও পরিবেশ শীর্ষক এক অনলাইন ওয়েবিনারে এ তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম সম্পাদক ডা. এম এইচ ফারুকী।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য সরকার স্বাস্থ্য খাতে বছরে ব্যয় করে মাথাপিছু ১০ ডলার বা ৮০০ টাকার একটু বেশি। কিন্তু পুরােপুরি রােগ নিরাময়ে জনপ্রতি গড়ে ৬০ ডলার সমপরিমাণ অর্থ প্রয়ােজন হয়। এক্ষেত্রে মানুষ জনপ্রতি গড়ে আরও ৩০ ডলার নিজ থেকে খরচ করে, আর বাকি থেকে যায় ২০ ডলার; যার দায় নিয়ে মানুষকে দেনাগ্রস্ত জীবনযাপন করতে হয়।
এইচ এম ফারুকী বলেন, দেশে ২০২০ সালের জুনে মােট জনসংখ্যার ২১ শতাংশের মতাে নতুন করে দরিদ্র হয়েছিল। আর ২০২১ সালের মার্চে এসে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ। করোনা মহামারিতে এটি আরও বাড়বে, যা বলার আশঙ্কা রাখে না।
বিজ্ঞাপন
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল
করােনা অতিমারি মােকাবিলায় বরাদ্দে জরুরি প্রয়ােজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকার থােক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। পরে সংশােধনে তা বেড়ে ৩১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা হয়। করােনা জরুরি চাহিদা মেটানাের জন্য গত বাজেটেও ১০ হাজার কোটি টাকার থােক বরাদ্দ ছিল।
স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে যা বলা হয়েছিল
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তৈরি করা ‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে' বলা হয়েছিল- ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে আনার ব্যবস্থা হবে।
এই কৌশলপত্র তৈরির সময় ২০১২ সালে স্বাস্থ্যের ব্যয়ে ব্যক্তির পকেট খরচ যেত ৬৪ শতাংশ, সরকার বহন করত ২৬ শতাংশ, আর অন্যান্য উৎস থেকে আসত বাকি ১০ শতাংশ। ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় ২০১৭ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ, ২০২০ সালে তা ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে জনবল
একজন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকার কথা ৩ জন সেবিকা ও ৫ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। আমাদের আছে ০.৩ জন সেবিকা আর ০.৬ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। এই স্বল্প জনবলের মধ্যে ২০১৯ সালে ২৭.২৭ শতাংশ পদই শুন্য ছিল।
প্রতি ১০,০০০ (দশ হাজার) মানুষের জন্য স্বাস্থ্যখাতে ভারতে জনবল ১৮.৫ জন, ভুটানে ১৯.৩ জন, থাইল্যান্ডে ২৮ জন, নেপালে ৩৩.৫ জন, শ্রীলংকায় ৩৬.৮ জন, মালদ্বীপে ১১৮ জন। সেগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ৮.৩ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আমাদের মতো দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মােটামুটি মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক, সেবিকা ও ধাত্রী মিলে থাকতে হবে ২৩ (তেইশ) জন (উন্নত বিশ্বমানের সেবার জন্য ৪৪ জন)।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ
মানুষের জীবনের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। স্বাস্থ্য নির্ভর করে জনগণের শিক্ষার মান, স্বাস্থ্য সচেতনতা, খাদ্য-পুষ্টি এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর।
২০১৫ সালে বিভিন্ন রােগব্যাধিতে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৪৩ হাজার। এর মধ্যে পরিবেশ দূষণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার মানুষের, যার মধ্যে বায়ু দূষণে মৃত্যু মােট মৃত্যুর প্রায় ২১ শতাংশ।
শুধু বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ আর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালে ১০টি স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করেছে, এর মধ্যে এক নাম্বার ঝুঁকি হচ্ছে বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন।
ডা. এইচ এম ফারুকী বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় বিদ্যমান স্বাস্থ্য সংকট কাটাতে এবং ভবিষ্যতে সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাজেট বৃদ্ধিই স্বাস্থ্য সেবায় সংকটের সমাধান নয় তবে এটা অন্যতম মূল সমস্যা। জনমত জরিপেও দেখা যায় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে জনগণের চাহিদার প্রথমে শিক্ষা ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্যখাত। কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থান আমাদের দেশে সব সময়ই ৭ম থেকে ৯ম স্থানে রয়েছে।
স্বাস্থ্যের সরকারি বরাদ্দকে খরচ হিসাবে মনে না করে একে বিনিয়ােগ হিসেবে ভাবতে হবে; কারণ এর মাধ্যমে দারিদ্র্য কমে, কর্ম-সংস্হান ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বাড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ফলে তৈরী হয় সুস্থ্য, সবল ও নীতিনিষ্ঠ সমাজ।
তিনি আরও বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ রক্ষার করণীয়গুলো আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও উপস্থাপনায় এ বিষয়গুলো বলে আসলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখছি না। তাই আমরা আবারও স্বাস্থ্যখাতের প্রতি সরকার ও রাজনৈতিক নেতার আরও মনােযােগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং সেই সঙ্গে একটি সুপরিকল্পিত রােগপ্রতিরােধ ও নিরাময় ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তােলার জন্য বাজেট বৃদ্ধির জোর দাবি জানাচ্ছি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রমুখ।
টিআই/জেডএস