কীভাবে করতে হয় ট্রেড লাইসেন্স, কী কী লাগে?
বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স করা বাধ্যতামূলক। যে ধরনের ব্যবসাই হোক না কেন ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে সেই ব্যবসাটির আইনগত বৈধতা থাকে না। লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা পরিচালনার জন্য জরিমানা কিংবা আইনি নানা জটিলতায় পড়তে হতে পারে। তাই ট্রেড লাইসেন্স একটি জরুরি বিষয়। অনেকে মনে করে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া একটি জটিল প্রক্রিয়া। আসলে তা নয়, বিষয়টি জানা থাকলে এটি খুবই সহজ একটি প্রক্রিয়া।
ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য কোথায় যেতে হয়?
বিজ্ঞাপন
ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য আবেদনকারীকে প্রথমে ঠিক করতে হবে তার ব্যবসাটি স্থানীয় সরকারের কোন ইউনিটের অধীনে পরিচালিত হবে। যেমন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা বা উপজেলা পরিষদ। একটি অফিস থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দেশব্যাপী ব্যবসা করা যায়। তবে ব্যবসা প্রসারের স্বার্থে স্থানীয় সরকারের অধীনে শাখা অফিস করতে হলে সেখানকার জন্য পৃথক ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে।
ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে কোন অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হবে তা নির্বাচন করতে হবে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যেকটিতে অঞ্চল রয়েছে দশটি করে আঞ্চলিক অফিস। এসব অফিসে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন ফর্ম পাওয়া যাবে এবং সেখান থেকেই চূড়ান্তভাবে ট্রেড লাইসেন্সটি দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
ট্রেড লাইসেন্স করতে প্রয়োজনীয় খরচ ও সময়
ব্যবসার ধরনের ওপর ভিত্তি করে যেভাবে লাইসেন্স পরিবর্তিত হয় ঠিক সেভাবেই বিভিন্ন ব্যবসার লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের মধ্যেও বেশ তারতাম্য ঘটে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ব্যবসার ধরনভেদে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এক নামে একাধিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। সিটি কর্পোরেশন আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬-এর বিধিমালা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্সের এই খরচের হারসমূহ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এর সঙ্গে আকৃতি অনুসারে সাইনবোর্ড ফি, লাইসেন্স বইয়ের খরচ ও এগুলোর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ হয়।
ট্রেড লাইসেন্সের আনুষঙ্গিক খরচাদি আবেদন ফর্মে উল্লেখিত ব্যাংক সমূহে জমা দেওয়ার মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় সময় লাগতে পারে আবেদন ফর্ম জমা দেওয়ার দিন থেকে সাত কর্মদিবস। পরে নির্দিষ্ট আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থান ব্যক্তিগত হলে সিটি কর্পোরেশনের হালনাগাদ হোল্ডিং ট্যাক্সের রশিদ, নিজের দোকান হলে ইউটিলিটি বিল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় হলে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে ভাড়ার চুক্তিপত্রে সত্যায়িত ফটোকপি লাগবে আর আবেদনকারীর ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে। ব্যবসা যদি যৌথভাবে পরিচালিত হয় তাহলে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে পার্টনারশিপের অঙ্গীকারনামা, শর্তাবলী জমা দিতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স করার নিয়ম
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হলে তাদের ওয়েবসাইটে (https://erevenue.dncc.gov.bd/cp/cportal/cp/northcc.aspx) গিয়ে নতুন ইউজার খুলে আবেদন করতে হয়। আবেদনকালে মালিকের ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি, অনাপত্তি সনদ, মূলধন প্রমানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি (লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস), মালিকানা প্রমানের জন্য দলিল/পর্চা (ভাড়াটিয়া হলে ভাড়ার চুক্তিপত্র), হালনাগাদ হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক লাইসেন্সের ফটোকপি (শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে), অন্যান্য পরিচয়পত্র/ছাড়পত্র এর কপি নির্ধারিত ফরমেটে আপলোড করতে হবে।
সিটি কর্পোরেশন লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার দিয়ে আবেদন যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ট্রেড লাইসেন্স অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। অনুমোদিত হলে লাইসেন্সধারীর কাছে নির্ধারিত ফি দেওয়ার জন্য এসএমএস পাঠানো হবে এবং মেইল করা হবে। ফি প্রদানের পর প্রিন্ট করা ট্রেড লাইসেন্সটি ডাকযোগে, কুরিয়ারের মাধ্যমে স্ব স্ব ঠিকানায় পৌঁছানো হবে। এছাড়া লাইসেন্সধারী নিজেও স্ব স্ব ইউজারে লগইন করে প্রিন্ট করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সময় লাগবে ৩ কর্মদিবস।
বর্তমানে অটো জেনারেটেড ট্রেড লাইসেন্স (ঝুঁকিপূর্ণ, জনসংবেদনশীল ব্যবসা ব্যতীত) আবেদন দাখিলের পর পেমেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স করার নিয়ম
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হলে তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে (http://erevenue.dscc.gov.bd/cp/cportal/cp/southcc.aspx) নতুন ইউজার খুলে আবেদন করতে হয়। আবেদন পত্রের সঙ্গে ৩ কপি ছবি, ভাড়ার চুক্তি পত্র ও ভাড়ার রশিদ, কর পরিশোধের রশিদসহ কর কর্মকর্তার বরাবর আবেদন করতে হয়। লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে মেমোরেন্ডামের কপি দাখিল করতে হয়। পরবর্তীতে লাইসেন্স সুপারভাইজার দ্বারা সরেজমিনে তদন্ত করে সঠিক পাওয়া গেলে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। সেক্ষেত্রে সময় ৩ দিন, স্বাস্থ্য বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের তদন্তের প্রয়োজন হলে ৭ দিন লাগতে পারে।
এছাড়া অনলাইনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করতে হলে ওয়বেসাইটে একটি নিবন্ধন ফরম পাওয়া যাবে। সেখানে নাম, মোবাইল ফোন নম্বর, ই-মেইল, ব্যবসার ধরনসহ বেশ কিছু তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করতে হবে। ফরম সাবমিট করলে আরেকটি ফরম আসবে। সেখানেও চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বর যুক্ত করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য কাগজপত্র স্ক্যান করে যুক্ত করতে হবে। সফলভাবে সাবমিট করলে সেবা গ্রহীতার মোবাইলে একটি মেসেজ পাবেন। সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট এলাকার রাজস্ব পরিদর্শকও বার্তা পাবেন।
পরে রাজস্ব পরিদর্শক কাগজপত্র যাচাইয়ের পর আবার ফিরতি মেসেজ যাবে সেবা গ্রহীতার মোবাইল ফোন ও ই-মেইলে। ফিরতি মেসেজে ট্রেড লাইসেন্স ফি’র পরিমাণ ও জমা দেওয়ার বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংকে গিয়ে ফি পরিশোধ করা যাবে। এছাড়া বিকাশ, রকেট বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও টাকা পরিশোধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফি জমার পরপরই সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স সুপারভাইজারের মোবাইল ফোনে মেসেজ যাবে।
এরপর লাইসেন্স সুপারভাইজার দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে একটি ই-ট্রেড লাইসেন্স ই-মেইল যোগে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবে। পাশাপাশি এসএমএসও পাবেন গ্রাহক। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ তিন দিন।
ব্যবসা করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স লাগবেই
ব্যবসাকে বৈধ করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স একটি অপরিহার্য সনদ। ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া এবং এর নবায়ন স্থানীয় সরকারের কর আদায়ের একটি মাধ্যম। এটি ছাড়া যেকোনো ব্যবসা প্রতারণার সামিল হবে। এ অপরাধে এমনকি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রতারণা হিসেবে দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলাও হতে পারে। তাই সঠিক ও বৈধ ভাবে ব্যবসা পরিচালনায় ট্রেড লাইসেন্স খুব জরুরি বিষয়।
এএসএস/এআইএস