বাঁশের সাঁকোর দুঃখ ভুলতে যাচ্ছেন আফতাবনগর-বনশ্রীবাসী
যে শহরে চলছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ছুটছে গাড়ি— সেই শহরেই এখনো মানুষ নিয়মিত বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। শুধু একটি-দুটি নয়, অল্প কিছু দূরত্বের এমন চারটি বাঁশের সাঁকো রয়েছে। যা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। এটি রাজধানীর অন্যতম আবাসিক এলাকা আফতাবনগর এবং বনশ্রীর প্রতিদিনের চিত্র।
বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকাকে সংযুক্ত করে রাখা কয়েকটি বাঁশের সাঁকো দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে সাঁকোগুলো এখন নড়বড়ে ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোটখাটো দুর্ঘটনা। সাঁকোগুলোর ওপর নির্ভর করে দুই পাশের লাখো মানুষের যাতায়াত, দুই পাড়ে সব মিলিয়ে রয়েছে প্রায় অর্ধশত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ছোট-বড় হাসপাতাল। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দুই এলাকার বাসিন্দারা আধুনিক ও স্থায়ী সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
বিজ্ঞাপন
আশার কথা হচ্ছে তাদের সেই দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। শুরু থেকেই এখানে ব্রিজ নির্মাণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটি (আফতাবনগর সোসাইটি)। বনশ্রী ও আফতাবনগরের লাখ লাখ মানুষের প্রতিটি মানুষের চাহিদা ছিল যেন দুই এলাকার মধ্যে সংযোগ সেতু হয়।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এখানে ২টি সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে যা দিয়ে মানুষসহ গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স পারাপার হতে পারবে। এছাড়া আরেকটি সেতু নির্মাণ হবে যা দিয়ে শুধু মানুষ চলাচল করবে।
আফতাবনগর- বনশ্রীর মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খালটির নাম নড়াই নদী। প্রস্তাবিত এখানকার সেতুর নাম হবে ‘নড়াই সেতু’। এটাকে সবাই বনশ্রী খাল নামে চিনলেও আশির দশকে এটি ছিল প্রবহমান নড়াই নদী। অবৈধ দখলের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে একে খালে রূপান্তর করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে একে পুনরায় ‘নড়াই নদী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
দুই এলাকার (বনশ্রী ও আফতাবনগর) লাখ লাখ মানুষের দাবি পূরণ হতে যাওয়া বা এখানে সেতু নির্মাণ হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক চেষ্টা, সিটি কর্পোরেশনের কাছে দাবি উত্থাপন। সাধারণ বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়া যা করেছে জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটি (আফতাবনগর সোসাইটি)। সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন ঢালী সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, এমনকি এখানে সেতু নির্মাণ ছিল তার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান অংশে। এটি নির্মাণের উদ্যোগের মাধ্যমে বাঁশের সাঁকোর দুঃখ ভুলতে যাচ্ছে আফতাবনগর-বনশ্রীবাসী। যেন এই নড়াই সেতুই মিলিয়ে দেবে দুই এলাকাকে।
আরও পড়ুন
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটির (আফতাবনগর সোসাইটি) সভাপতি আলমগীর হোসেন ঢালীর সঙ্গে। তিনি সব দিক তুলে ধরে বলেন, সোসাইটির সভাপতি হিসেবে আমার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্যতার সঙ্গে ছিল এখানে সেতু নির্মাণ। যা প্রথমে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে করতে চেয়েছিলাম। এলাকাবাসী এই সেতুর মাধ্যমে খুব উপকৃত হবে এবং তাদের এটা দাবি ছিল। সেলক্ষ্যেই আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে আমরা নিজস্বভাবে ব্রিজের প্ল্যান, নকশা আমরা করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে এসব কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষও।
তিনি বলেন, পরে আমি এলাকাবাসীর পক্ষে থেকে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। দিনের পরদিন এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কখনো আমি এককভাবে সিটি কর্পোরেশনের অফিসের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি, আমাদের এখানকার সেতুর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছি। সচিবালয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গেছি এখানকার সেতুর দাবি নিয়ে। উত্তর সিটির প্রশাসক, ইঞ্জিনিয়ারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দিনের দিনের পর মিটিং করেছি, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি এখানে সেতু কতটা প্রয়োজন। আগের প্রশাসক, নতুন প্রশাসকসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আমাদের কথা শুনেছে। তারা এখন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। মোট ৩টি সেতু হবে এখানে। দুইটি দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে বাকি একটি দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করবে।
দীর্ঘদিন ধরে আফতাবনগরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন আজিজুল ইসলাম নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরে আফতাবনগর এবং বনশ্রীর বাসিন্দারা বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এপার ওপার যাতায়াত করে, কিন্তু এত মানুষ দাবি জানালেও এতদিন ধরে এখানে কোনো ব্রিজ নির্মাণ হয়নি। আফতাবনগর সোসাইটি নিজের উদ্যোগে এখানে ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করার পাশাপাশি বেশ কিছু কাজ এগিয়েছিল। পরে তারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বারবার উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আবেদন, দৌড়াদৌড়ি করে।
তিনি বলেন, এখন সিটি কর্পোরেশন এখানে ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে করে আমাদের এত সুবিধা হবে যাতায়াতে যা বলে প্রকাশ করা যাবে না। আফতাবনগর-বনশ্রীবাসীর খুশির যেন শেষ নেই, এখানে ব্রিজ হওয়ার খবর জানার পর থেকে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে আমাদের আফতাবনগর সোসাইটি এই ব্রিজ বাস্তবায়ন করার জন্য অনেক কষ্ট, চেষ্টা করেছে। আমি যতদূর জানি আফতাবনগর সোসাইটির সভাপতি আলমগীর হোসেন ঢালী ভাইয়ের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তিনিই দিনের পর দিন খুব দৌড়াদৌড়ি করেছেন- এখানকার সেতু নির্মাণের জন্য। তার প্রতি আমরা আফতাবনগর-বনশ্রীবাসী আসলেই কৃতজ্ঞ।
বনশ্রীর আরেক বাসিন্দা সাবিনা আক্তার বলেন, এখানে ব্রিজ হওয়া খুবই জরুরি ছিল। হাজার হাজার মানুষের উপকার হবে এখানে সেতু নির্মাণ হলে। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, আমার ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ওপারে স্কুলসহ আত্মীয়দের বাসায় যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু বাঁশের সাঁকোর মাধ্যমে ওপারে যাওয়া অনেকটা অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা খুব খুশি যে আফতাবনগর সোসাইটি অনেক চেষ্টার মাধ্যমে এখানে ব্রিজ নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে উদ্বুদ্ধ করেছে, আমাদের দাবি আদায় হয়েছে। এখন ভালোভাবে ব্রিজগুলো নির্মাণ কাজ শুরু করে দ্রুত আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে গত ১৯ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ আফতাবনগর-বনশ্রী এলাকা পরিদর্শন করে ঘোষণা দিয়েছেন যে, আফতাব নগর থেকে বনশ্রী যাওয়া-আসার জন্য প্রধান সড়ক ছাড়া বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই। তাই এলাকাবাসীর সুবিধার্থে এই নড়াই নদীর ওপর দুইটি সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে যা এই দুই আবাসিক এলাকার মধ্যে সহজ ও সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে।
প্রশাসক বলেন, প্রস্তাবিত এ সেতুর নাম হবে ‘নড়াই সেতু’। যে খালটিকে আমরা আজ বনশ্রী খাল নামে চিনি, আশির দশকে এটি ছিল প্রবহমান নড়াই নদী। অবৈধ দখলের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে একে খালে রূপান্তর করা হয়। আমাদের উদ্যোগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে একে পুনরায় ‘নড়াই নদী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এই নদী রক্ষা করতে পারলে ভবিষ্যতে রামপুরা থেকে নৌপথে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বালু নদী হয়ে সদরঘাট ও মিরপুর পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন চালু করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
জানা গেছে, আফতাবনগর- বনশ্রী এলাকার মানুষের যাতায়াতে কষ্ট দূর করতে সিটি কর্পোরেশন থেকে তিনটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হবে সেতু। যেগুলোয় গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি ফুটপাতে মানুষ হাঁটতে পারবে। আর একটি ফুটওভার ব্রিজও (পদচারী সেতু) নির্মাণ হবে। অল্প সময়ের মধ্যে এগুলোর কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এএসএস/এমএ