শুরু হলো নির্বাচনী ডামাডোল
রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতির নির্দেশ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে নির্ধারণ হয়ে গেছে জাতীয় নির্বাচনের সময়। শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে পেশাদারিত্বের বিপরীতে পুলিশের যে বিতর্কিত ভূমিকা ছিল সেখান থেকে বের হয়ে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে ডিএমপির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (১১ আগস্ট) রাজধানীর রাজারবাগের বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ডিএমপির ‘জুলাই-২০২৫’ মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, দীর্ঘদিন পর এ দেশে সুন্দর একটা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। এ নির্বাচনে বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকরা উপস্থিত থাকবেন। পুরো পুলিশ বাহিনীর মান-মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে হবে। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ঢাকা মহানগর এলাকায় পর্যাপ্ত জনবল মোতায়েন থাকবে।
বিজ্ঞাপন
সভায় উপস্থিত ডিএমপির এক উপকমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে কমান্ডিং পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। তাদের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ও সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার ও সরকারি দল পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা অত্যন্ত বিতর্কিত ও হতাশাজনক। এই জায়গা থেকে পুলিশের বড় ইউনিট হিসেবে ডিএমপিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক কোনো মতাদর্শে প্রভাবিত ও উৎসাহিত না হয়ে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া, পুলিশের নিরাপত্তামূলক তৎপরতা ও পরিকল্পনা গ্রহণে স্ব স্ব ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতের নির্বাচনী ভূমিকা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। এবারের জাতীয় নির্বাচনে পুলিশকে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে ডিএমপির সক্ষমতা বৃদ্ধি, লজিস্টিক সাপোর্ট, জনবল বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য কী কী লাগবে, সেটার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা ইউনিটের সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসন বা এলাকার কোনো চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা থাকলে তা জানাতে বলা হয়েছে।
সভায় উপস্থিত সদ্য অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয় ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতকে বিবেচনায় নিয়েই আগামী জাতীয় নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষ রাখার বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশনা আজকে দেওয়া হয়েছে। যখন যা লাগবে তা হবে। কিন্তু নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে কোন আপস করা যাবে না। জনবল লাগবে কি না তা পর্যালোচনা চলছে। নির্বাচনী প্রশিক্ষণের বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রক্রিয়াধীন।
ডিএমপির গোয়েন্দা রমনা বিভাগের উপকমিশনার(ডিসি) মো. ইলিয়াস কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত নির্বাচনের মতো যেন কারচুপি, বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশের দূরতম যোগাযোগ না থাকে, নিরপেক্ষ থেকে পেশাদারি দায়িত্ব পালনে যা যা করা দরকার তাই করতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনী আসন ধরে ভোটকেন্দ্রের অবস্থা, থানা থেকে দূরত্ব, নিরাপত্তা পরিকল্পনা, কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা, কত জনবল লাগবে; সেসব জানতে চাওয়া হয়েছে। সব বিভাগ নির্দেশনা মোতাবেক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, ডিএমপিকে পরিকল্পনা ও সমস্যা জানাতে বলা হয়েছে।
সভায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, জনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ডিএমপির সব সদস্যকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। এ ছাড়া অপরাধ সম্পর্কে আগাম তথ্য সংগ্রহ করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি করতে হবে।
সভায় কমিশনার মোটরসাইকেল ব্যবহার করে রাজধানীতে অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং নিয়ন্ত্রণে কাগজপত্রবিহীন মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন।
সভায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমেদ বলেন, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিআইএমএস) তথ্য নিয়মিত আপডেট রাখতে হবে। সিআইএমএসের তথ্যের সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করবে।
তিনি আরও জানান, ওয়ারেন্ট তামিল ও চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন, যেন মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
সভায় যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন ‘জুলাই-২০২৫’-এর সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন।
অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এস এন মো. নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মো. মাসুদ করিম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস্, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হাসান মো. শওকত আলীসহ যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপির সব থানার অফিসার ইনচার্জ এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জেইউ/এমজে/জেএস