# ২০ তারিখের মধ্যে দিতে হবে মতামত
# বেশি নোট অব ডিসেন্ট বিএনপির
# কোনো নোট অব ডিসেন্ট নেই এনসিপির
# এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, জরুরি অবস্থা জারিতে বিরোধীসহ একাধিক প্রস্তাবে সব দল রাজি

জুলাই সনদ-২০২৫ এর পূর্ণাঙ্গ খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন। এই খসড়ার কোনো শব্দ, বাক্য গঠন বা কোনো বিষয়ে মন্তব্য থাকলে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে কমিশনে জমা দেওয়া অনুরোধ করা হয়েছে। তবে, এতে সংস্কার কার্য সম্পাদনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা রাখা হয়নি, যা কমিশনের আগের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এর আগে গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত প্রাথমিক খসড়ায় কমিশন বলেছিল, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সব সংস্কার কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে হবে।

কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় কমিশন বলছে, যেসব সুপারিশ ‘অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে বিবেচিত হবে তা অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের দ্রুত, কার্যকর ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচনের আগেই। তবে কোন সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য তা খসড়ায় উল্লেখ করা হয়নি।

কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাষা ও শব্দচয়ন বিষয়ে মতামত জানাতে দলগুলোকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে খসড়ার ‘বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত থাকবে’।

সনদে কোনো সময়সীমা না রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক খসড়ায় দুই বছরের সময়সীমা কেবল আলোচনা শুরু করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল। এটা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল না।’

অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো আলাদা করে না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারই চিহ্নিত করবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

যেসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের সংশোধনীর প্রস্তাবে বিএনপি রাজি হলেও প্রস্তাবে লিখিত ‘রাষ্ট্রপতি কারও পরামর্শ ও সুপারিশ ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুটারি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ প্রদান করবেন’— প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি।

প্রধামন্ত্রীর একসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবে না- সংবিধানে এরূপ বিধান যুক্ত করতে হবে, কমিশনের এমন প্রস্তাবে অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। 

নিম্নকক্ষের ভোটের অনুপাতে (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষরে ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবে- এই প্রস্তাবে অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। 

ন্যায়পাল নিয়োগ সাংবিধানিক কমিটি গঠন, সরকারি কর্ম কমিশনের নিয়োগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ঐক্যমত কমিশনের এসব প্রস্তাবে অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি।  

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে সই করলেও, দলটি রাজি নয় এমন সিদ্ধান্তগুলো নির্বাচনে জয়ী হলে বাস্তবায়ন করবে না।

এছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সংসদীয় বাছাই কমিটি গঠনে একমত হলেও, র্যাং ক চয়েজ ভোটের সিদ্ধান্তেও রাজি নয় বিএনপি।

রাজনৈতিক দলগুলো নিন্মকক্ষের নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় প্রকাশের সময় একইসঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। তালিকায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ নারী থাকতে হবে- কমিশনের এই প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি।

৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলে ঐকমত্য কমিশনের প্রথামিক প্রস্তাব ছিল, অর্থবিল বাদে বাকি সব বিষয়ে এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। বিএনপি প্রস্তাব করে, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিল এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্তে ভোট দেবেন। বিএনপি নোট অব ডিসেন্টসহ একমত হয়েছে। দলটি জানিয়েছে, দলের প্রস্তাব আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে রাখা হবে। বিএনপি ভোট জয়ী হলে, এই চার বিষয় বাদে বাকি বিষয়ে এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।

কমিশনের প্রস্তাব ছিল, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। বিএনপি এতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে জানিয়েছে, জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারকের একজনকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।

জুলাই সনদ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জুলাই সনদের খসড়া হাতে পেয়েছি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে বিএনপির পক্ষ থেকে মতামত জানানো হবে।

নারীদের সরাসরি নির্বাচন ও ‘ওপেন গভর্নমেন্ট’-এ রাজি নয় জামায়াত

রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের ‘ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ’-এর পক্ষভুক্ত হওয়া-কমিশনের এমন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে জামায়াত। 

সরাসরি নির্বাচনে নারীদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতায় রাজি নয় জামায়াত। কমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে ৭ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দিতে আহ্বান থাকবে। অর্থাৎ কোন দল ১০০ আসনে প্রার্থী দিলে, সাতজন নারী প্রার্থী দেবে। পরের নির্বাচনে তা আরও ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তখন সংবিধান সংশোধন করে নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হবে। জামায়াত জানিয়েছে, তারা সংসদে নারী আসন বৃদ্ধি করে ১০০ করতে রাজি। তবে আসন বন্টন হতে হবে পিআর পদ্ধতিতে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, কমিশন একটি প্রস্তাব দিয়েছিল—আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থী দেওয়া জন্য উৎসাহিত করা হবে। আমরা এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম।

তিনি আরও বলেন, আমরা কমিশনের দেওয়া জুলাই সদনের খসড়া পেয়েছি। কিন্তু এখনও দলীয় ফোরামে আলোচনা করার সুযোগ পায়নি।

নোট অব ডিসেন্ট নেই এনসিপির

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় রাজনৈতিক ঐকমত্যের ৮৪টি প্রস্তাবে কোনও নোট অব ডিসেন্ট নেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)।

তবে এনসিপি পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদ সদস্যরা শুধু আস্থা ভোট দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারবেন না। ৭ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়নের সিদ্ধান্তেও আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি। দলটি প্রস্তাব করেছে, অন্তত ১৫ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।

২৭টি দল সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে রাজি হলেও সিপিবি, বাসদ, জমিয়ত একমত হয়নি। সংবিধানের মূলনীতিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার যুক্ত করতে রাজি হয়নি সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ। নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে গণফোরাম, মার্কাসবাদী বাসদ, জেএসডিসহ কয়েকটি দল। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গেলে মূলনীতিতে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করবে।

এলডিপি, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট, সমমনা জাতীয় জোট, এনডিএম, জমিয়ত, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামে ইসলামী পার্টিও একই অবস্থান জানিয়েছে।

সংসদে নারী আসন বৃদ্ধি এবং সরাসরি মনোনয়নে রাজি নয় ইসলামী আন্দোলনসহ ছয় ধর্মভিত্তিক দল। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, “আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে তারা যা বলবেন, দলগুলো সেটি মানতে বাধ্য থাকবে।”

উল্লেখযোগ্য যেসব বিষয়ে একমত সব রাজনৈতিক দল

এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না, স্বাধীন পুলিশ কমিশন, জরুরি অবস্থা জারিতে বিরোধী নেতার সম্পৃক্ততা, মৌলিক অধিকার সম্প্রাসরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় আইন, নির্বাচন কমিশন গঠনে সাংবিধানিক কমিটি, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি, সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬ এবং ৫৮ (ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোট, গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা সীমিত করে আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীয়করণ করে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং উপজেলায় আদালত স্থাপনসহ ১১টি সিদ্ধান্তে সবদল একমত হয়েছে।

এএইচআর/এসএমডব্লিউ