বড় গ্যাসফিল্ডের উৎপাদন কমছে, বাড়ছে শঙ্কা
দেশে প্রতিনিয়ত কমছে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন। এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদনের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনো ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। এ খাতে উন্নতি আনতে হলে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিগত সরকার প্রাকৃতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বদলে গুরুত্ব দিয়েছিল আমদানিতে। তাই এখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
পেট্রোবাংলা বলছে, চলতি বছর দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। গত ১৩ আগস্ট পর্যন্ত তারা সরবরাহ করতে পেরেছে (এলএনজিসহ) ২ হাজার ৮৩২ মিলিয়ন ঘনফুট।
কোনো গ্যাসকূপ আবিষ্কার থেকে শুরু করে উৎপাদনে আনতে ৩ বছর সময় লাগে। একটি ল্যান্ডবেইজড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনেও সময় লাগে প্রায় ৭ মাস। অন্যদিকে, বিবিয়ানাসহ বড় গ্যাসফিল্ডের মজুত আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। এ অবস্থায় কোনো কারণে কূপগুলোর উৎপাদনে বড় রকমের ধস দেখা দিলে দেশের গ্যাস পরিস্থিতি বড় বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস খাত নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
গ্যাস উৎপাদনের চিত্র
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বেসরকারি মালিকানাধীন মোট ২২টি গ্যাসফিল্ড থেকে চলতি বছর গড়ে উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। যেখানে গত বছর একই সময়ে উৎপাদিত হয়েছে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বৃহৎ গ্যাসফিল্ড হিসেবে পরিচিত তিতাসের ২৬টি গ্যাসকূপ থেকে এ বছর উৎপাদন হচ্ছে ৩১৯ মিলিয়ন ঘনফুট, গত বছর যেখানে উৎপাদিত হয়েছে ৩৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বছরের ব্যবধানে হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডের উৎপাদন ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে নেমে এসেছে ৯০ মিলিয়ন ঘনফুটে। রশীদপুর গ্যাসফিল্ডের উৎপাদনও ৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে নেমে এসেছে ৬১ মিলিয়ন ঘনফুটে। তবে কিছু গ্যাসকূপের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলেও তা যথেষ্ট নয়।
অন্যদিকে, শেভরনের মালিকানাধীন দেশের বৃহৎ গ্যাসফিল্ড বিবিয়ানার উৎপাদনও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত বছর গড়ে এই ফিল্ড থেকে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এ ছাড়া জালালাবাদ গ্যাসফিল্ডের উৎপাদন কমে ১৫২ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ১৩৭ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।
এলএনজির মাধ্যমে ভারসাম্য আনার চেষ্টা
প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। দেশে বর্তমানে এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত বছর এই সক্ষমতায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়। তবে চলতি বছর তা বাড়িয়ে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ গ্যাসের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মেটানো হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় তা সামাল দিতে গিয়ে মজুত কমছে। মজুত কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সে কারণে চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গ্যাসকূপের মুখে কম্প্রেসার বসিয়ে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের উচিত ছিল গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া। কিন্তু তা না করে তারা আমদানিতে নজর দিয়েছে। বর্তমানে ১১০০ মিলিয়ন এলএনজির সক্ষমতা থাকলেও সেটি আরও বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালীতে তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল, পায়রাতে ভাসমান টার্মিনাল, সাতক্ষীরার ভোমরা-খুলনা গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন, বেনাপোল-খুলনা পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে গ্যাস আমদানি এবং ভোলা-বরিশাল-খুলনা পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
বিশেষ বিধানের আওতায় সেসময় সামিট গ্রুপের সঙ্গে মহেশখালীতে ভাড়াভিত্তিক ভাসমান এলএনজি স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর ও পায়রাতে ভাসমান টার্মিনালের জন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত ধাপে ছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে বিশেষ বিধান বাতিল করে এসব প্রকল্প বন্ধ করে দেয়।
এসবের মধ্যে দেশের গ্যাস পরিস্থিতির সহসাই কোনো উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কোনো গ্যাসকূপ আবিষ্কার থেকে শুরু করে তা উৎপাদনে আনতে ৩ বছর সময় লাগে। আবার একটি ল্যান্ডবেইজ এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনেও সময় লাগে প্রায় ৭ মাস। অন্যদিকে, বিবিয়ানাসহ বড় গ্যাসফিল্ডের মজুত আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। এ অবস্থায় কোনো কারণে কূপগুলোর উৎপাদনে বড় রকমের ধস দেখা দিলে দেশের গ্যাস পরিস্থিতি বড় বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের এই সংকটটা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। বিগত সরকার অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানিতে জোর দিয়েছিল। সেটা যে একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা তারা মেনে নিয়েছিল। পরে তারা গ্যাসকূপ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছিল।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে গ্যাস খাতের যে পরিস্থিতি, তা স্বস্তিদায়ক নয়। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০০ গ্যাসকূপ খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা একটি ভালো উদ্যোগ। যদিও এই সরকারের সময়কালে তা সম্ভব হবে না। সুতরাং সামনে যে সরকার আসবে, তাদের উচিত হবে এই কার্যক্রম গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়ন করা।
সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে আমরা এক্সপ্লোরেশন করছি, যদিও তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সার্বিকভাবে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে সময়ের প্রয়োজন। আমাদের সময়ে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আমরা গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করে যাব, যাতে ভবিষ্যতের সরকার সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে।
ওএফএ/এসএসএইচ/জেএস