সচিবালয়–যমুনা’র নিরাপত্তা: বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি, কার্যকর হচ্ছে কি?
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক এলাকা সচিবালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ঘিরে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও মিছিল–সমাবেশে বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও মাঠে তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে অনেকের মধ্যেই।
ঢাকায় চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সরকারি স্থাপনার নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পর্যালোচনা সাপেক্ষে বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করলেও বাস্তব পরিস্থিতি অন্য চিত্র উপস্থাপন করছে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অর্ডিন্যান্স নং-III/৭৬-এর ২৯ ধারার ক্ষমতাবলে সচিবালয়, যমুনা এবং সংলগ্ন এলাকা—হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্রসিং, কাকরাইল মসজিদ ক্রসিং, অফিসার্স ক্লাব ক্রসিং এবং মিন্টো রোড ক্রসিং এলাকাায় সব ধরনের সভা, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট এবং শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছে একাধিকবার। তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ মাসের মধ্যে অন্তত পাঁচবার একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রথমবার মে মাসে সচিবালয় ও যমুনা এলাকায় সভা–সমাবেশ নিষিদ্ধের নির্দেশ আসে। এরপর জুনে বিচারপতি এলাকা ও সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন অঞ্চলে অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। জুলাই ও আগস্টে পুনরায় নতুন নির্দেশ জারি হয়। সর্বশেষ ৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সই করা গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সচিবালয়, যমুনা ও সংলগ্ন এলাকা—হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্রসিং, কাকরাইল মসজিদ ক্রসিং, অফিসার্স ক্লাব ক্রসিং এবং মিন্টো রোড ক্রসিং—যেকোনও সভা, মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট বা শোভাযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু মাঠে দৃশ্য ভিন্ন; নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রায় সময়ই তার কোনো তোয়াক্কা না করে যমুনা ও সচিবালয়ের আশপাশে কর্মসূচি পালন চলছে। মিছিল, ঝটিকা সমাবেশ কিংবা মানববন্ধনের মতো আয়োজন ঠেকাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিজ্ঞাপন
আবার অনেক সময় পুলিশ ঠেকাতে গেলেও হয় সংঘর্ষের ঘটনা। এতে উল্টো চাপ আসে পুলিশের উপর। তাই মাঝে মধ্যে সামান্য বাধা দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। এতে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে কি না, সে সংক্রান্ত সংশয় থেকেই যাচ্চে।
রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এসব আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকায় ১,৬০৪টি অবরোধ হয়েছে। এসব কর্মসূচি দিয়েছে ১২৩টি সংগঠন। অবরোধ ও মিছিলে রাজধানীর রাস্তাগুলোতে তীব্র যানজট এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। সচিবালয় ও যমুনার আশপাশের মিছিল ও সমাবেশের কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ ব্যাপরে বলেন, “জনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কেউ আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা অনেক সময় কৌশল অবলম্বন করি, যেন সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত ভোগান্তিতে না পড়ে। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ সীমিত রাখা হলেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একই এলাকায় বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেও মাঠে তা কার্যকর না হলে জনগণের আইনের প্রতি আস্থা কমে যায়। আইন সমভাবে প্রয়োগ না হলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারেও প্রশ্ন ওঠে।
নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক এ বিষয়ে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমে গেছে। শুধুমাত্র কঠোর অবস্থান প্রদর্শন করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। তাই কৌশল অবলম্বন করে জনমনে আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনাই একমাত্র সমাধান। বিশেষ করে পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের আন্দোলনের আগে সমস্যা সমাধানে তৎপরতা বাড়ানো দরকার।”
সচিবালয় ও যমুনা সংলগ্ন এলাকার ক্রমাগত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বারবার নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা প্রশাসনিক সক্ষমতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা তৈরি করছে। সাধারণ মানুষ শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির। অফিসগামী কর্মী থেকে শুরু করে পথচারী ও যানবাহন চালক—সবাই এই কর্মসূচির কারণে নাভিশ্বাসে পড়ছেন। সামান্য একটি সড়কের অংশ বন্ধ হয়ে গেলেও পুরো শহরের যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।
অধ্যাপক ওমর ফারুকের মতে, শুধু কঠোর অবস্থান দেখানোই যথেষ্ট নয়; কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা, আগাম সতর্কীকরণ ও সমস্যা সমাধানে তৎপরতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
এমএসি/এসএমডব্লিউ