বর্ষা এলেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কাটেনি বহু বছরের দুর্ভোগ
বর্ষা এলেই ঢাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতার চিরচেনা চিত্র। পানিতে ভাসে ঢাকার রাস্তাঘাট। সামান্য বৃষ্টিতেই বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে যায়। দুই সিটি কর্পোরেশন নানা উদ্যোগ নিলেও দীর্ঘদিনের এই সমস্যা থেকে নগরবাসী এখনও মুক্তি পায়নি।
এদিকে রাজধানীতে গতকালের টানা বৃষ্টির পর সকাল থেকেই বহু এলাকা পানিতে ডুবে যায়। নিউ মার্কেট, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর ১৩, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও-জাহাঙ্গীর গেট সড়ক, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা, মোহাম্মদপুর, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, ইসিবি, কালশি ও সাঁতারকুলসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) জানায়, বুধবার থেকে রামপুরা ইউলুপের নিচে এবং মিরপুর ১, কালশি, সাঁতারকুল, নিকেতন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করে পানি অপসারণ কার্যক্রম চলছে। সড়কের ম্যানহোল খুলে পানি নিষ্কাশনের কাজও অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) জানিয়েছে, তাদের ওয়ার্ডভিত্তিক ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম কাজ করছে। তবে খাল-নদীর পানির স্তর বেশি হওয়ায় নিষ্কাশন ধীরগতির ছিল। ফলে কিছু এলাকায় পানি নামতে সময় লেগেছে।
এদিকে বৃষ্টি হলেই বারবার এমন জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাসিন্দারা।
বকশিবাজার এলাকার বাসিন্দা মকিদুর রহমান বলেন, বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ। গতকাল আমাদের পুরো এলাকায় হাঁটু পানি জমে ছিল, আজও কিছু অলিগলিতে পানি রয়ে গেছে। নিয়মিত এই সমস্যা হলেও সিটি কর্পোরেশন স্থায়ী সমাধান করছে না।
নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী সাদিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবার বৃষ্টিতে আমাদের দোকানপাট ডুবে যায়। লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। আমরা বারবার জানিয়েছি, তবুও সমাধান নেই। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম বা ভারি বৃষ্টি হলেই আমাদের দোকান বারবার ডুবছে।
কালশি এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, প্রতিবার বৃষ্টি হলেই আমাদের এলাকা ডুবে যায়। পরে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এসে পানি নিস্কাশনের কাজ শুরু করে। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমাদের সাধারণ বাসিন্দাদের। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি চাই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম নিয়মিত কাজ করছে। তবে খাল-নদীর পানির স্তর বেশি হওয়ায় নিষ্কাশন ধীরগতির হয়। এ সময় পোর্টেবল পাম্প ব্যবহার করে দ্রুত পানি সরানো হয়। সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার সময় কমলাপুরে হাই প্রেসার ভার্টিক্যাল পাম্প বসানো হয়েছিল।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) জানিয়েছে, শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্লু-নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা চলছে।
জলাবদ্ধতা হ্রাসে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে: প্রবণ এলাকা চিহ্নিতকরণ, মানচিত্রায়ন, হটস্পট শনাক্তকরণ ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ। ১০টি অঞ্চলে ২০টি কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে, যা নিয়মিত পিট, ক্যাচ পিট ও ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করছে।
ডিএনসিসি দাবি করছে, এই উদ্যোগের ফলে জলাবদ্ধতা দ্রুত কমছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিএনসিসি ২২১.৮৫ কিমি স্ট্রম ওয়াটার ড্রেন এবং ১.৫৪৭ কিমি বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করেছে। একই সময়ে ১১০.৯৩ কিমি রাস্তা ও ১০৫.৮৯ কিমি নর্দমা নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। ডিএনসিসির আওতাধীন ২৯টি খালের মধ্যে মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৮ কিমি; এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ২৪ কিমি খাল পরিষ্কার ও খনন করা হয়েছে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, খাল ও জলাধারের কার্যকর পরিচালনার জন্য ৩৬০ জন পরিছন্নতা কর্মী নিয়োজিত করা হয়েছে। ২৯টি খাল এবং ১টি রেগুলেটিং পন্ডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং খালপাশে ১৩০০টি সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। রিটেনশন পন্ড ও খালের জন্য জিআইএস ডাটাবেস ও হটস্পট ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে এবং ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিআইএস প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
পাম্পিং স্টেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজও চলমান। রামপুরা পাম্পিং স্টেশনে ৫টি ৫ কিউমেক ক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প রয়েছে, এছাড়া ১টি নতুন পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণপুর পাম্পিং স্টেশনে ৩.৩ কিউমেক ক্ষমতার ৩টি এবং ৫ কিউমেক ক্ষমতার ২টি পাম্প রয়েছে। নতুন ১৬ কিউমেক ক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প হাউজ নির্মাণের জন্য ডিপিপি প্রস্তুত হচ্ছে। কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড থেকে প্রায় ১.১২ লাখ ঘনমিটার স্লাজ অপসারণ করা হয়েছে।
কল্যাণপুর ও রামপুরা পাম্প স্টেশন ছাড়াও মিরপুর ও আব্দুল্লাহপুরে ২টি ছোট পাম্প স্টেশন সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কল্যাণপুর প্রধান খাল ও বেগুনবাড়ী খালের বিভিন্ন অংশে প্রায় ১,২৩,৫৬৪ ঘনমিটার স্লাজ অপসারণের কাজ চলমান।
ডিএনসিসি’এর নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক ও ড্রেনেজ উন্নয়ন প্রকল্প (ফেজ-১) চলমান। এ প্রকল্প সম্পন্ন হলে সেকেন্ডারি ড্রেনেজ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতা হ্রাস পাবে।
জানা গেছে, একসময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। পরে রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত ১৫ বছরে ঢাকা ওয়াসা, দুই সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে, তবু নগরবাসী জলাবদ্ধতার সমস্যার মুক্তি পায়নি।
আগে ঢাকা মহানগরীর প্রধান ড্রেন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার হাতে ছিল, আর শাখা লাইনের দায়িত্ব ছিল সিটি কর্পোরেশনের। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিমি ঢাকা ওয়াসার এবং প্রায় ২,৫০০ কিমি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এছাড়া ৭৪ কিমি দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল এবং ১০ কিমি বক্স কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণও ছিল ওয়াসার দায়িত্বে। এই বিভাজনের কারণে বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল চ্যানেলিং ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বহু খাল ও ড্রেন পরিষ্কার করেছি। মূল সড়কের জলাবদ্ধতা অনেকটা কমেছে। পুরো ঢাকাকে ঠিক করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কাজ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে যেটা বড় সমস্যা- মূল সড়কের জলাবদ্ধতা সেটা কিন্তু দুই তিন মাসের মধ্যে অনেকটা ঠিক করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এটা পার্মানেন্টলি ঠিক করার জন্য কি কি উদ্যোগ নিতে হবে কি কি করা যায় সে অনুযায়ী কাজ করা।
এএসএস/এমএসএ