একমাত্র মেয়ে-জামাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সুলতান মিয়া

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের একপাশে নিথর হয়ে বসে আছেন মিরপুরের অগ্নিকাণ্ডে সন্তান হারানো মধ্যবয়সি এক বাবা। পাশেই কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, কেউ বসে-দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন আর আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে আসা স্বজনের খোঁজ নিচ্ছেন।

তবে খুবই অভিমানী ভঙ্গিমায় হাসপাতালের গ্রিলে হেলান দিয়ে পাশে বসে আছেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার মোল্লা রাজাপুর গ্রামের মো. সুলতান মিয়া। তার চোখদুটি শুকনো, কাঁদার শক্তিটুকুও যেন ফুরিয়ে গেছে। মুখে শুধু একটাই বাক্য বলছেন, ‘আমি এখন খালি হাতে বাসায় ফিরব কী নিয়ে? মেয়ের মাকে কী বলে সান্ত্বনা দেব?’

বুধবার (১৫ অক্টোবর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে সরেজমিনে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। 

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে মিরপুরের রূপনগরে একটি পোশাক প্রিন্টিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সুলতান মিয়া একসঙ্গে হারিয়েছেন তার একমাত্র মেয়ে মারজিয়া সুলতানা (২২) এবং মেয়ের জামাই জয় আহমেদকে (২৫)।

জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে ওই কারখানার রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়, যেখানে মেশিন চালাচ্ছিলেন কর্মীরা। সেখান থেকেই আর ফিরতে পারেননি মারজিয়া ও জয়।

সুলতান মিয়া জানান, একমাত্র আদরের মেয়ে মারজিয়া এক সপ্তাহ আগেই এই কারখানায় যোগ দিয়েছিল ‘হেল্পার’ হিসেবে। বিয়ের বয়স তিন মাসও পেরোয়নি। চাচাতো ভাই জয় আহমেদের সঙ্গে সংসার গড়ার শুরুটাও ঠিকমতো হয়নি। 

তিনি বললেন, মেয়েটা কখনও ঘর থেকে একা বের হয়নি। বলেছিল, সংসারে একটু সাহায্য করব। সেই জন্য চাকরিতে যোগ দিলো। এখন মনে হয়, যেই কাজ দিলাম, সেই কাজেই মেয়েটা চলে গেল।

মারজিয়ার বাবা জানান, মারা যাওয়ার দিন সকালেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এখনও সেই কথাগুলো তার মাথায় বাজছে। “সকাল দশটার দিকে আমি ফোন দেই, ও বলে, ‘বাবা, আমি মেশিন চালাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না।’ এক ঘণ্টা পর শুনি আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি ফোন দেই, তখন ও বলল, ‘বাবা, আমি নিচে নামতেছি, আবার উপরে যাচ্ছি। কিন্তু দারোয়ান দুইটা গেট বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা বের হতে পারছি না।’ এইটুকু বলেই ফোনটা কেটে দেয়।”

সুলতান মিয়া জানান, আগুনের খবর শুনেই ছুটে যান রূপনগরে। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছেছি, কিন্তু তখন সব শেষ। আগুনে পুরো বিল্ডিংটা পুড়ে গেছে। জামাইয়ের লাশটা চিনেছি, কিন্তু মেয়ের লাশ এখনও পাইনি। একটা মেয়ের লাশ দেখেছি, কিন্তু আরেক পরিবার সেটা তাদের মেয়ে বলে দাবি করেছে। সকাল থেকে হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি আর কিছু চাই না– শুধু আমার মেয়ের মরদেহটা চাই।

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ের পরনে ছিল হলুদ জামা, হাতে ঘড়ি, মাথায় সবসময় একটা বেল্ট পরতো। আমি শুধু ওর সেই মুখটা একবার দেখতে চাই।

পাশে দাঁড়ানো মারজিয়ার মামা এমদাদুল হক তখন চোখ মুছছিলেন। গলা ভারী করে বললেন, আমার বোন (মারজিয়ার মা) সারারাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কেউ কথা বলতে পারে না ওর সঙ্গে। মাঝে মাঝে চোখ খুলে বলে, ‘আমার মেয়েকে একবার দেখতে দে।’ বাড়ির সবাই পাথর হয়ে গেছে। কেউ খায়নি, কেউ ঘুমায়নি। এখন আমরা শুধু লাশটার অপেক্ষায় আছি।

এমদাদুল আরও বললেন, মারজিয়া আর জয় একসঙ্গে কাজে যেত, একসঙ্গে ফিরতো। তাদের নতুন সংসার ছিল। সংসার গড়ার আগে কেউ ভাবেনি, একটা আগুন সব শেষ করে দেবে।

মিরপুরের ভাড়া বাসাটা এখন নিস্তব্ধ। দেয়ালে ঝুলে থাকা তাদের বিয়ের ছবিটা যেন হঠাৎ নিঃশেষ জীবনের সাক্ষী হয়ে গেছে। সুলতান মিয়া বললেন, আমার ঘরে এখন শুধু মেয়ের জামাকাপড় আছে। ওর মায়ের মুখে কিছু খায় না, আমি জানি না কীভাবে তাকে সান্ত্বনা দেব। আমি জানি না, মেয়েকে ছাড়া কীভাবে রাতে ঘুমাব।

ঢাকা মেডিকেলের মর্গের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমি শুধু মেয়ের মরদেহটা হাতে নিয়ে ঘরে ফিরতে চাই। তারপর যা হবে, হোক।

প্রসঙ্গত, এর আগে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে ফায়ার সার্ভিসের কাছে আগুনের সংবাদ আসে। পরে সংবাদ পাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ১১টা ৫৬ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর আগুনের প্রায় ২৮ ঘণ্টা চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সর্বশেষ কাজ করে ঘটনাস্থলে। ভয়াবহ এই আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন্য নিহত হয়েছে।

টিআই/বিআরইউ