মেট্রোরেলের প্যাড পড়ে পথচারী নিহত
দুর্ঘটনার পর ঝুঁকি নিয়ে চলে ২ ট্রেন, নকশা পুনর্মূল্যায়ন চান বিশেষজ্ঞরা
সংগৃহীত
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্তে নেমেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মেট্রোরেলের পুরো প্রকল্প অডিট করে এর নকশার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে, অভিযোগ উঠেছে প্যাড খুলে যাওয়ার পর সতর্কতামূলক তথ্য জানানো হলেও তা আমলে না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওই পথে তখন আরও দুটি ট্রেন চালানো হয়েছে। এই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে মেট্রোরেলের অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের (ওসিসি) বিরুদ্ধে।
বিজ্ঞাপন
এমআরটি লাইন–৬–এর দায়িত্বশীল সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছে, ঘটনার সময় ওই জায়গার কাছাকাছি তিনটি ট্রেন লাইনে ছিল। সামনের ট্রেন অপারেটর ওসিসিকে জানান ফার্মগেট স্টেশনে ঢোকার সময় ট্রেন লাফ দিয়ে উঠেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ট্রেনের জন্য কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ট্রেন ফার্মগেট ডাউন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সময় নিচের দিকে ডেবে গিয়ে আবার লাফিয়ে ওঠে। ওই ট্রেন থেকেও তাৎক্ষণিকভাবে ওসিসিকে বিষয়টি জানানো হয়। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এরপরও ওসিসি ট্রেন চলাচল বন্ধ করেনি। আপ লাইন দিয়ে আরেকটি ট্রেন ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণির দিকে প্রবেশ করে। সেই ট্রেন থেকেও রিপোর্ট করা হয় যে, ট্রেন কাত হয়ে যাচ্ছে এবং যাত্রীরা ভয় পাচ্ছেন। এর পরে ওসিসি থেকে সব ট্রেনকে প্ল্যাটফর্মে থামার (প্ল্যাটফর্ম হোল্ড) নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
ক্ষয় হতে হতে পড়লো মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড
দায়িত্বশীল আরেকটি সূত্র জানায়, পড়ে যাওয়া বিয়ারিং প্যাড পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এটি দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এক প্রান্তে পাতলা ও অন্য প্রান্তে মোটা হয়ে গেছে। এমনটি একদিনে হয়নি, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হয়েছে। ফলে পাতলা অংশে ট্রেনের চাপ পড়ায় সেটি খুলে পড়ে যায়। সূত্রের ধারণা, রক্ষণাবেক্ষণ (মেইনটেন্যান্স) টিম বিষয়টি এতদিন লক্ষ্য করেনি, যা রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির ইঙ্গিত দেয়।
এ বিষয়ে এমআরটি লাইন–৬–এর অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. সাজিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি গণসংযোগ কর্মকর্তার (পাবলিক রিলেশন অফিসার) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এর আগে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ফার্মগেট স্টেশনের পর ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের সামনের একটি পিলারের (৪৩০) ওপর থাকা ভায়াডাক্টের চারটি স্প্রিংয়ের একটি সরে গিয়েছিল। সেখানে রুটের অ্যালাইনমেন্ট উঁচু–নিচু হয়ে যায় এবং সে সময়ও ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
প্রায় দেড়শো কেজি ওজনের বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ায় গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খামারবাড়ি এলাকায় মেট্রোরেল অংশে নকশাগত ত্রুটি থেকেই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কার্ভ সেকশনগুলো হাই–স্পিড চলাচলের উপযোগী নয় এবং বিয়ারিং প্যাডের গাইডিং মেকানিজম দুর্বল বা অনুপস্থিত থাকতে পারে। এ অবস্থায় পুরো নকশা দ্রুত পুনর্মূল্যায়ন (রিভিউ) করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা প্যাডগুলোকে স্ক্রু–লক বা সুরক্ষিত কাঠামোয় স্থাপন এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিয়ে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ অডিট করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিয়ারিং প্যাড কী, বারবার খুলে পড়ছে কেন
বিয়ারিং প্যাড হলো রাবার ও স্টিলের তৈরি এক ধরনের নমনীয় আয়তাকার গঠন, যা মেট্রোরেলের পিলার (পিয়ার) ও উপরের ভায়াডাক্ট অংশের মাঝখানে স্থাপন করা হয়। এটি অনেকটা শক অ্যাবজরবারের মতো কাজ করে— ট্রেন চলাচলের সময় উৎপন্ন কম্পন ও ভারসাম্যজনিত চাপ শোষণ করে কাঠামোকে রক্ষা করে। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্প্যান ৩০ থেকে ৪০ মিটার দীর্ঘ কংক্রিটের অংশ নিয়ে তৈরি, যা পিলারের ওপর বসানো হয়। দুটি কঠিন কংক্রিট কাঠামোর সরাসরি সংযোগ ক্ষয় ও ঘর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে; সেই ঝুঁকি কমাতে বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি পিলারে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড থাকে, যেগুলো রাবার ও বিশেষ মানের স্টিলের স্তরে স্তরে সংযুক্ত। এই উপাদানগুলোই পুরো ভায়াডাক্ট কাঠামোর স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাড বসানোর জন্য নিচে বিশেষ বেজ বা ভিত্তি তৈরি থাকে। এই প্যাডগুলো সাধারণত কোনো নাট–বল্টু বা স্ক্রু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং মেট্রোরেলের পিলার ও ভায়াডাক্ট— দুটি ভারী কংক্রিট কাঠামোর চাপে স্বাভাবিকভাবে স্থির থাকে। প্রতিটি স্প্যানের ওজন কয়েকশ টন হওয়ায় সেটি নিজ ভারেই স্থিতিশীল থাকার কথা। তবু, এত ভারী কাঠামোর নিচ থেকে প্যাড ছিটকে পড়ার বিষয়টি প্রকৌশলবিদদের কাছেও বিস্ময় তৈরি করেছে।
এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল, পেছনে নকশাগত বা স্থাপনসংক্রান্ত ত্রুটি থাকতে পারে
ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রবাবিলিটি ইজ দ্যাট (সম্ভাবনা হলো) যে ওইখান থেকে হয়তো যখন জার্কিং ছিল গাড়ি, তখন হয়তো এটা পড়তে পারে। হয়তো স্লিপ করে এই সাইডে আসতে পারে। পরে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে গেছে।
তিনি বলেন, এটা পৃথিবীর সব দেশেই আছে, এইভাবেই আছে। যারা কন্ট্রাক্টর ছিল — টাইকেন এবং টেকেন এভিনিকো আবদুল মোনেম— এদের ইনভেস্টিগেশন (তদন্ত) আমি দেখছি। আগেও এরকম একটা ঘটনা হয়েছে। তখন আমাদের স্টেপ (পদক্ষেপ) নেওয়া হয়েছে, স্টেপ কার্যকরীও হয়েছে। এখন দেখতে হবে যে এটা কার্যকরী হওয়ার পর কেন এই ঘটনাটি ঘটল।
ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা বাইরে থেকে এক্সপার্ট (বিশেষজ্ঞ) আনার ব্যবস্থা করছি। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কোনোদিন কারও মৃত্যু চায় না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল এবং এর পেছনে নকশাগত বা স্থাপনসংক্রান্ত ত্রুটি থাকতে পারে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে ডিএমটিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। উল্লেখ্য, মেট্রোরেলের পুরো কাঠামো— লাইন, স্প্যান ও বিয়ারিং প্যাডসহ— নকশা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল জাপানের পরামর্শক সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগ এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন।
রাবার প্যাডগুলোর জন্য সঠিক ‘গাইডিং মেকানিজম’ নেই
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা নকশাগত ত্রুটির ফল হতে পারে। ঢাকা মেট্রোরেলকে ‘হাই–স্পিড করিডর’ ঘোষণা দেওয়া হলেও কার্ভ বা বাঁক অংশে নকশাগত সীমাবদ্ধতার কারণে ট্রেনের গতি ৩০–৩৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে হচ্ছে। এতে প্রকল্পের হাই–স্পিড মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে।
তিনি বলেন, ভায়াডাক্ট ও পিলারের মাঝে ব্যবহৃত ইলাস্টোমেরিক রাবার প্যাডগুলোর জন্য সঠিক ‘গাইডিং মেকানিজম’ নেই। ফলে এগুলো সময়ের সঙ্গে স্থানচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করছে। এই নকশা জাপানি হলেও ঢাকার জটিল ভৌগোলিক গঠন ও কার্ভযুক্ত সেকশনগুলো এতে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এজন্য পুরো করিডর পুনরায় অডিট করে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে নকশা পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।
হাদিউজ্জামান বলেন, শুধু কার্ভ নয়, সোজা অংশগুলোও ঝুঁকিমুক্ত কি না তা যাচাই করা জরুরি। প্রয়োজনে প্রতিটি বিয়ারিং প্যাডের চারপাশে সুরক্ষা রেলিং বা স্ক্রু–ফিক্সিং ব্যবস্থা করা উচিত। নকশাগত ঘাটতি সংশোধন না করলে এমন দুর্ঘটনা পুনরায় ঘটতে পারে, যা প্রকল্পের নিরাপত্তা ও আস্থা উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
এদিকে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, দুর্ঘটনার তদন্তে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে যাওয়া নাশকতা কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এমএইচএন/এমজে