আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অবশেষে তিনটি নতুন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলগুলো হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) এবং বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি।

তবে, দল নিবন্ধনের চূড়ান্ত তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে তারেক রহমানের আম জনতার দল। নিবন্ধন না পেয়ে গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিকেল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের মূল ফটকের সামনে আমরণ অনশনে বসেছেন দলটির সদস্য সচিব তারেক রহমান। প্রায় ৫০ ঘণ্টা ধরে তার এই অনশন চলছে এবং শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটেছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তারেকের অনশনকে সমর্থন জানিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তারেকের সঙ্গে দেখা করে তার অনশনকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিভিন্ন দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তারেককে সমর্থন জানালেও নির্বাচন কমিশন বলছে— বিদ্যমান আইনের শর্ত পূরণ না করার কারণেই নিবন্ধন পায়নি আম জনতার দল। তারেক চাইলে আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন বলে জানিয়েছে ইসি।

শর্ত পূরণ না করায় নিবন্ধন দেয়নি ইসি

দলটিকে নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে গত বুধবার (৫ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশন একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৯০খ (১) (ক) (ই)-এর শর্তাবলী সঠিকভাবে পালন না করা, দুই-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানা দলিল সংযুক্ত না করা এবং দলের নামে রক্ষিত ব্যাংকের তথ্য দাখিল না করাসহ বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।

৯০খ (১) (ক)-তে যেসব শর্ত আছে

(ক) নিম্নবর্ণিত শর্তাদির যে কোনো একটি পূরণ করিতে হইবে- যথা:- (অ) বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর হইতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক লইয়া কমপক্ষে একটি আসন লাভ; বা (আ) উপরি-উক্ত সংসদ নির্বাচনের যেকোনো একটিতে উক্ত দলের প্রার্থী কর্তৃক নির্বাচনে অংশগ্রহণকৃত আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট লাভ; বা (ই) কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস, উহা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, অন্যূন এক তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা অফিস এবং অন্যূন একশতটি উপজেলা বা, ক্ষেত্রমত, মেট্রোপলিটন থানায় অফিস প্রতিষ্ঠা যাহার প্রত্যেকটিতে সদস্য হিসাবে ন্যূনতম দুইশত ভোটারের তালিকাভুক্তি।

৯০খ (১) (ক) (ই)-তে যেসব বিষয় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্মচারী বা শ্রমিকদের সমন্বয়ে বা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকা। তবে শর্ত থাকে যে, তাহাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হইবার বা সংগঠন, সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, ইত্যাদি গঠন করিবার ও বর্ণিত সব প্রকার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করিবার ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তি হিসেবে, বিদ্যমান আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, রাজনৈতিক দলের সদস্য হইবার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকিবে না।

আরও যেসব ঘাটতি পূরণ করতে পারেনি আম জনতার দল

জেলা কার্যালয়ের তথ্য ঘাটতি : দুই-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা দপ্তরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ, চুক্তিপত্র বা মালিকানা দলিল সংযুক্ত করা হয়নি। মাঠপর্যায়ের তদন্তে ২২টির মধ্যে মাত্র ২০টি জেলায় সঠিক ও কার্যকর অফিস থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

উপজেলা বা থানা অফিসের তথ্য ঘাটতি : নিবন্ধনের শর্তানুযায়ী ১০০টি উপজেলা বা থানা অফিসের মধ্যে মাত্র ৩৩টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানায় অফিস ও ২০০ জন ভোটার সদস্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

আর্থিক তথ্য অনুপস্থিতি : দলের নামে রক্ষিত ব্যাংকের তথ্য এবং দলের তহবিলের উৎসের বিবরণ দাখিল করা হয়নি।

গঠনতন্ত্রে অসঙ্গতি : গঠনতন্ত্রে কোনো পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সদস্য পদ সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়নি।

অঙ্গ সংগঠন সংক্রান্ত বিধান : গঠনতন্ত্রে শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন না থাকার বিধান রাখা হয়নি।

ক্ষমতাপত্র এবং প্রত্যয়নপত্রের অভাব : নিবন্ধনের আবেদন করার জন্য দল প্রদত্ত ক্ষমতাপত্র এবং সংবিধান পরিপন্থী না হওয়া ও দণ্ডিত ব্যক্তি না থাকার বিষয়ে দলের প্রধানের ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্র দাখিল করা হয়নি।

ইসিকে প্রতারক বললেন তারেক

নিবন্ধন না দেওয়ার কারণ জানিয়ে ইসির দেওয়া চিঠিকে প্রতারণামূলক আখ্যা দিয়েছেন অনশনরত তারেক রহমান। তিনি বলেন, ইসি আমাদের একটা প্রতারণামূলক চিঠি দিয়েছে। আমরা নাকি ব্যাংক তথ্য দেইনি, ৩৩ শতাংশ নারীর বিধান রাখা হয়নি... এগুলো তারা একটা মিথ্যা ক্লেইম করছে।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, আমাদের বলছে ২২টা জেলায় লাগবে, আমাদের ২০টা জেলায় অফিস পেয়েছে। দুইটা জেলায় নাকি পায়নি। আমাদের তো ৪৩টা জেলায় কমিটি আছে। তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দল নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আম জনতার দল শর্ত পূরণে অনেক পিছিয়ে ছিল। আমাদের চেষ্টা ছিল, যেসব দল শর্ত পূরণের কাছাকাছি থাকবে তাদের বিষয়টি বিবেচনার জন্য। কিন্তু তারা জেলা ও উপজেলা অফিস বা কমিটিতে অনেক পিছিয়ে ছিল। এজন্য দল নিবন্ধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করার আগে একাধিকবার বিভিন্ন অফিসার দিয়ে তদন্ত করিয়েছি। এখন তারা নির্বাচন কমিশনের সামনে অনশন না করে আদালতে যেতে পারে বা চিঠিতে যেসব শর্ত পূরণ হয়নি সেগুলো পূরণ করতে পারে। কারণ, নির্বাচন কমিশন আইনের বাইরে গিয়ে কিছুই করতে পারে না।

ইসির শর্ত না মেনে অনশন আইন পরিপন্থী : অ্যাডভোকেট শাহজাহান

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শর্ত পূরণ না করে কোনো দলের অনশন করা এবং সেটিকে সংহতি জানানো আইনের পরিপন্থী বলে ঢাকা পোস্টের কাছে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, দেশের আইন-কানুন না মেনে অনশন করে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করলে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।

‘নির্বাচন কমিশনের শর্ত যদি পূরণ না করে কেউ অনশন করে এবং এই কাজটাকে যদি কেউ সমর্থন জানায়, তাহলে সেটা আইনের পরিপন্থী হবে। আইন কেন প্রণয়ন করা হয়? কারণ আইনটা যাতে সবাই মানে। আর যদি কেউ না মানে, তাহলে ওই আইনটা প্রয়োগ করে আদালতে বিচার দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন যে আইনটা করেছে, সেটার অনুমোদন আছে এবং তারা আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যদি আম জনতার দল মনে করে আরপিও-এর বিধিবিধানের আলোকে তাদের দাবি সঠিক, তবে তাদের উচিত হবে অনশন না করে আইনি পথে হাঁটা। এখন আরপিও-এর বিধিবিধানের আলোকে যদি তার (আম জনতার দল) দাবি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে উনি আদালতে মামলা করতে পারেন।

আমরণ অনশনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও ইসিকে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে হবে বলে মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, আমরণ অনশনের নামে কোনো চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করলেও নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। যারা দেশের আইন-কানুন না মেনে অনশন করে, আইন ভঙ্গ করার দায়ে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

ড. শাহজাহান পরামর্শ দিয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন যেহেতু আইনের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাই এই পরিস্থিতিতে ইসিকে নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং প্রার্থীর ১ শতাংশ ভোটারদের স্বাক্ষর বাদ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। এই বিষয়টির পক্ষে আমার কাছে যথেষ্ট যুক্তি আছে।

তিন দলের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু

এদিকে, গত মঙ্গলবার ইসি সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে দাবি-আপত্তি চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হ্যান্ডশেক মার্কায় বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, শাপলা কলি মার্কায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং কাঁচি মার্কায় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কবাদী) নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে। এই দলগুলোর বিরুদ্ধে কারো কোনো দাবি-আপত্তি থাকলে আগামী ১২ নভেম্বরের মধ্যে লিখিত আকারে ইসির সিনিয়র সচিবের কাছে জানাতে বলা হয়েছে।

দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তির পর বা কোনো আপত্তি না থাকলে এই দলগুলোকে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে বলে জানান সচিব।

এসআর/এমজে