আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূর জাহান (২৮) ১০টি নাম ব্যবহার করে তিন দেশে (ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাই) নারী পাচার করতেন। মূলত তিনি ওই তিন দেশে নারী পাচারে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতেন। পাচারের কৌশল হিসেবে একেক সময় একেক নাম ব্যবহার করা হতো।

গত সোমবার (২১ জুন) নদী আক্তার ইতিসহ মানবপাচার চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল থানা পুলিশ। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- আল আমিন হোসেন (২৮), সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মন্ডল (২৬), তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)।

মঙ্গলবার (২২ জুন) সকালে রাজধানীর তেজগাঁও ডিসি কার্যালয়ে এসব কথা বলেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।

মো. শহিদুল্লাহ বলেন, পাচারের উদ্দেশে আনা মেয়েদের যশোর সীমান্তে বিভিন্ন বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত চক্রটি। পাচারকরা প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্যকে এক হাজার টাকা করে দেওয়া হতো। পাচারকালে কোনো মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতো।

তিনি বলেন, ২০০৫ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে নদীর বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে রাজীব বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এরপর থেকেই নদী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পাচারকরা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নদীর দশটির মতো নাম পাওয়া যায়। নদী ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে।

এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, পাচার নারীদের কাছে তিনি নিজেকে নদী নামে পরিচয় দিলেও ভারতে সবাই তাকে ইতি নামে চেনেন। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। বাংলাদেশি পাসপোর্টে নুর জাহান, সাতক্ষীরা সীমান্তে জলি আর যশোর সীমান্তে তিনি প্রীতি নামে পরিচিত।

ডিসি তেজগাঁও বলেন, গ্রেফতার আল আমিন হোসেন ২০২০ সালে ঈদ উল আযহার চারদিন পর নারী পাচার করতে গিয়ে বিএসএফ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়। পাচারের উদ্দেশে আনা মেয়েদের সীমান্তে তার বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাঠানো হতো। নারী পাচারে সহায়তাকারী ওই ইউপি সদস্যের নামে যশোরের শার্শা থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রেফতার সাইফুল ইসলামের শর্শার পাঁচভুলট বাজারে মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা আছে। মানব পাচারে জড়িত ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই, সবুজ, আল আমিন ও একজন ইউপি সদস্য তার মাধ্যমে মানবপাচার থেকে অর্জিত অর্থ বিকাশে লেনদেন করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে সে মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের সতর্ক করে। বিকাশ ট্রানজেকশনে ব্যবহৃত মোবাইলটি জব্দ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার পলক মন্ডল যশোরের মনিরামপুর ঢাকুরিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গাহঘাটা থানার নলকড়া গ্রামে নানা বাড়িতে যায়। সেখানে পঞ্চগ্রাম স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাস করে। পরে BAMS (Bachelor of Ayurvedic Medicine and Surgery) ডিগ্রি নিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুরু করে। বেনাপোলের ইস্রাফিল হোসেন খোকন, ভারতে অবস্থানকারী বকুল ওরফে খোকন, তাসলিমা ওরফে বিউটি ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিতে আসা গ্রাম্য দরিদ্র মেয়েদের ব্যাঙ্গালুরে তাসলিমা ওরফে বিউটি নামে একজনের কাছে পাঠানোর মাধ্যমে নারী পাচারের হাতেখড়ি। পরে বাংলাদেশ থেকে পাচারকরা মেয়েদের আধার কার্ড প্রস্তুত করে দেওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ 'সেফ হোম' এ অবস্থান এবং ব্যাঙ্গালুরে নির্ধারিত স্থানে পাঠানোর দায়িত্ব নেয়।

মো. শহিদুল্লাহ বলেন, এছাড়াও তিনি (পলক) ভারতীয় আধার কার্ড ও ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডধারী। উত্তর প্রদেশের গোরাক্ষপুর জেলার বড়ালগঞ্জ থানার নেওয়াদা গ্রামেও থেকেছে। তার কাছ থেকে ভারতীয় আধার কার্ড, আইডি কার্ড, ভারতীয় আয়কর বিভাগ দেওয়া আইডি কার্ড, সিম কার্ড ও একজন ভিকটিমের আধার কার্ড জব্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রেফতার বিনাশ সিকদার নড়াইলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি বেনাপোলে বাসা ভাড়া নিয়ে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করেন। তার স্ত্রী সোনালী সিকদার ভারতীয় নাগরিক। বেনাপোলে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতে গিয়ে ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই সবুজ ও মানবপাচারে জড়িত আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

তিনি আরও বলেন, সেই পরিচয়ের সূত্রধরে মানবপাচারের জড়িয়ে পড়েন। যশোর ও নড়াইল থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরি বা প্রলোভন দেখিয়ে আনা নারীদের ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আল আমিন, তরিকুল, আমিরুল ও আরও কয়েকজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে ভারতীয় দালালদের কাছে পৌঁছে দেয়। তার কাছ থেকে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেফতাররা ভারতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে তৈরি করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো তৈরিতে ভারতীয় লোকেরা সহায়তা করেছে।

গ্রেফতাররা কতজনকে ভারতে পাচার করেছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করেছি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বিস্তারিত সব জানতে পারবো।

নদীর সঙ্গে টিকটক হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা জানতে চাইলে ডিসি তেজগাঁও বলেন, নদী, হৃদয় বাবুসহ আরও দু'একজনের নাম আগে উল্লেখ করেছিলাম। তাদের সঙ্গেও নদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং পরস্পর যোগসাজশে পাচার করেছে।

ভারতে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে ওই ভিডিওর সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততা কতটুকু? এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিসি বলেন, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেহেতু নদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু ওই ভিডিওর সঙ্গেও নদীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

এমএসি/এসএম