দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্তের হার সে চিত্রই দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সবশেষ তথ্যমতে, দেশে করোনাভাইরাসের শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে আবারও আইসিইউ সংকট তৈরি হচ্ছে। এরইমধ্যে রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড ১৫টি সরকারি হাসপাতালের তিনটিতেই কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই।

এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে দ্রুত করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগী শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর সাধারণ শয্যা থেকে শুরু করে কেবিন ও আইসিইউতে রোগীর চাপ বাড়ছে। অনেক জটিল রোগীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ ও কেবিন সাপোর্ট দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে রাজধানী ঢাকার অন্যতম তিনটি সরকারি হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। অথচ গত সপ্তাহেও এসব হাসপাতালের সাধারণ শয্যাসহ আইসিইউর অনেক বেড ফাঁকা ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ২৭৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে একটিও খালি নেই। বরং শয্যার বাইরে আরও তিনজন রোগী ভর্তি রয়েছে। ১০টি আইসিইউর কোনোটিই খালি নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ৩৪৬টি। আর ২০টি আইসিইউ শয্যার কোনোটি খালি নেই। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ২৬৩টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। তবে ২৪টি আইসিইউ শয্যার একটি মাত্র খালি রয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৭৩টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। তবে ১০টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। 

এর বাইরে করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১৬৯ সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ৫৪টিতে, ফাঁকা ১১৫টি। ২৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ১০টিতে। খালি রয়েছে ১৬টি। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৭৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৫৭টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। তবে ১৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১০টি খালি রয়েছে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৯০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৬৮টি ফাঁকা আছে, ছয়টি আইসিইউ শয্যার চারটি ফাঁকা রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ২৩০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৩৮টি ফাঁকা রয়েছে। ২০টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে, চারটি ফাঁকা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালের ৪৭০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ফাঁকা ৩৭৩টি। ১৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৭টি খালি রয়েছে। মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ৫০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৪৮টি শয্যাই ফাঁকা। এ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২৭টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১০৫টিই ফাঁকা রয়েছে। ১০টি আইসিইউর মধ্যে খালি রয়েছে মাত্র দুইটি। শ্যামলী টিবি হাসপাতালে ১৮৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১৬৯টি শয্যা খালি রয়েছে, এছাড়া পাঁচটি আইসিইউর সবগুলোই ফাঁকা রয়েছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ১০৪টি শয্যার মধ্যে ৪৯টিই ফাঁকা রয়েছে। ১০টি আইসিইউর ৭টিই খালি রয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে ১৫টি সাধারণ শয্যার ১০টিই ফাঁকা রয়েছে। ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে ২৫০টি শয্যার সবগুলোই ফাঁকা রয়েছে। সেই সঙ্গে ২১২টি আইসিইউ শয্যার ১৩৪টি ফাঁকা রয়েছে।  

সবমিলিয়ে রাজধানীর ১৫টি সরকারি হাসপাতালে তিন হাজার ৪৫৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে দুই হাজার ২৬১টি খালি রয়েছে। এছাড়াও মোট ৩৮৪টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৯০টি শয্যা ফাঁকা আছে। এর আগে গত এপ্রিলে করোনা রোগী বাড়ায় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট তীব্র হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারও বাড়ছে। এই অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় তিনটি। প্রথমটি হচ্ছে- রোগী শনাক্ত করা। এর মাধ্যমে সবাইকে ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এদের মধ্যে যারা হাসপাতালে রয়েছে, তারা তো চিকিৎসার মধ্যেই রয়েছে। আর যারা হাসপাতালে নেই, বাসায় আছে তাদেরকে টেলিমেডিসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যেন তারা বিপদ সংকেতটা বুঝতে পারে যে কখন হাসপাতালে যেতে হবে। তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করা। আর যাদের আইসোলেশনে থাকতে সমস্যা, যাদের কামাই-রুজিতে অসুবিধা হয়, তাদেরকে সহায়তা দিতে হবে যেন তারা ঘরে থাকতে পারে।’

দ্বিতীয়ত হচ্ছে -সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এলাকাভিত্তিক কমিটি করে দিতে হবে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং তদারকি করতে হবে। 

আর তৃতীয়ত হচ্ছে- টিকা প্রদান। যেহেতু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টিকা নেই, এখন থেকেই ক্যাম্পেইন করতে হবে। টিকা আসা মাত্রই যেন সবাই টিকা নেয় সেটি নিশ্চত করতে হবে। এই তিনটি পদ্ধতিতেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণ নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই বাড়ুক বা অন্য যেকোনো কারণেই; আমাদেরকে অবশ্যই এটি টেনে ধরতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাইরাস পরিবর্তন হচ্ছে দিনদিন। যেটি সর্বশেষ আসে, সেটিই সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীর একশটিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই তিনটি পদ্ধতি মেনে চলছে, সেখানে সংক্রমণ কম। প্রতিটি দেশেই সংক্রমণ ছড়ানোর নিয়ম যেমন এক, তেমনি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার নিয়মও একই। যেসব রোগী হাসপাতালে ঢুকে, তাদের কষ্টটা বেশি হয়। কিন্তু এটা প্রতিরোধ করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এই তিনটি নিয়মেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে লাকডাউন করায় আশা করি ভালো সুফল মিলবে। ওই জেলাগুলো থেকে যদি ঢাকাসহ অন্যান্য জেলাগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চলাফেরা করতে না পারে, তাহলে সারাদেশেই সংক্রমণ কমতে শুরু করবে। এক্ষেত্রে লকডাউন করা জেলাগুলোতে রোগী শনাক্ত করে তাদেরকে আইসোলেশনে রেখে দিতে হবে। লকডাউনের একটা উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন ঘোরাফেরা করতে না পারে।

তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে লাকডাউন করে সুফল পাওয়ার চেয়ে ঢাকায়ও আমাদেরকে নজর দিতে হবে। ঢাকায় হয়তো বা লকডাউন দেওয়ার দরকার নেই, কিন্তু খুবই কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। যেমন- সন্ধ্যার পর সব চলাচল বন্ধ করা; রেস্টুরেন্ট, টি-স্টল, বিভিন্ন স্থানে আড্ডা- এগুলো বন্ধ করা উচিত। একইসঙ্গে কনভেনশন সেন্টারগুলোতে বিয়ে থেকে শুরু করে যত ধরনের আয়োজন করা হয়, সব অনুষ্ঠান আপাতত স্থগিত করা উচিত।

আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার আমাদের এখানে যত রোগী শনাক্ত হবে, এগুলোকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রান্সমিশনের চেইনটাকে ভাঙতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণ হতেই থাকবে। সামনে ঈদ উপলক্ষে গরুর হাট, এগুলোতে খুব কড়াকড়ি করা উচিত। আমাদের মেয়রদেরকে এসব বিষয়ে আরও সক্রিয় হওয়া উচিত। এখন ঢাকাতে এখন সংক্রমণ কম, তাই বলে সংক্রমণ যে বাড়বে না এটাতো ধারণা করা ভুল।

বিশ্বজুড়ে ফের বেড়েছে সংক্রমণ, মৃত্যু আরও ৮ হাজার

চলমান করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফের বেড়েছে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা। একইসঙ্গে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যায় বেড়েছে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ব্রাজিলে। অন্যদিকে দৈনিক মৃত্যুতে ভারত রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে।

এতে বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৭ কোটি ৯৯ লাখের ঘর। অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার।

একই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ জন। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮৯ হাজার। এতে মহামারির শুরু থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯ হাজার ৮৪৪ জনে।

দেশে করোনায় আরও ৭৬ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৪৮৪৬

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৭০২ জনের। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৪৬ জন। মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ জনে।

টিআই/জেডএস