চারিদিকের বাতাস এখনো ভারী। পোড়া গন্ধটা যেন কড়াইল বস্তির প্রতিটি ধূলিকণায়, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে। গতকালের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর, আজ সকালে সূর্যের আলো ফুটতেই স্পষ্ট হয়েছে ধ্বংসের এক বীভৎস ক্যানভাস। সেখানে জীবনের কোনো রং নেই, আছে শুধু ছাই আর হাজারো মানুষের বুকফাটা হাহাকার।

বুধবার (২৬ নভেম্বর) সরেজমিন কড়াইল বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে গতকালও ছিল সারি সারি টিনের ঘর, সেখানে আজ কেবলই পোড়া স্তূপ। বাঁশ, কাঠ আর টিনের ভাঙা টুকরোগুলো একাকার হয়ে আছে মাটির সঙ্গে। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই গতকাল পর্যন্ত মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলো বাসা বাধা ছিল।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো এখন এই ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছে। কেউ নিরবে, কেউবা বিলাপ করতে করতে। তারা ছায়ের মধ্যে খুঁজে দেখছে, তাদের সামান্য সম্বল, অতি সাধারণ জিনিসপত্র— আশ করছে হয়তবা কিছু আগুনে পুড়ে ছাই হয়নি, যা এখনো অক্ষত আছে।

এক মধ্যবয়সী নারী, যার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, তিনি দুহাত দিয়ে ছাই সরিয়ে দেখছেন। যদি তার সন্তানের কোনো খেলনা, যদি তার মাথার চুল বাঁধার একটি ক্লিপ— এমন ছোট কিছুও খুঁজে পাওয়া যায়! কিন্তু সেখানেও শুধু হতাশা। দীর্ঘশ্বাসে ছাইয়ের মধ্যে হাতড়াচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের পাশে বিড়বিড় আওয়াজ করে যাচ্ছেন।

তিনি রেহেনা খাতুন। স্বামী একটি ভাতের হোটেলে কাজ করেন, আর তিনি নিজেও মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। রেহেনা খাতুন বলেন, সব শেষ কিচ্ছু নেই। আজ দুপুরে কি খাবো সেটাও জানা নেই। ঘরের টিন সরিয়েছি কিন্তু একটা সুতাও সরাতে পারিনি। চারদিকে পোড়া গন্ধ। তবুও খুঁজছি এই পোড়া স্তূপ, ছায়ের মধ্যে যদি কিছু অবশিষ্ট, অক্ষত থাকে। বাচ্চাটা ওই খেলনার পোড়া অংশ দেখাচ্ছে, তাই খুঁজে দেখছি আর কোনো খেলনা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। পোঁড়া স্তূপ ছাইয়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে কান্না পাচ্ছে তাই একা একাই কথা বলছি।

এরা আগে গতকাল রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুন পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার বেশ কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছে অনেকেই। যারা তাদের জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকু হারিয়েছেন।

বস্তির কুমিল্লা পট্টির পোড়া ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জুলফিকার আলী বলেন, কত মানুষের স্বপ্নের শেষ ঠিকানা ছিল এই বস্তি। জীবন জীবিকা, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য এটাই আমাদের আবাসস্থল। কিন্তু এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। একটি নতুন জামা, সামান্য অলঙ্কার, ছেলে-মেয়ের বই সবই আজ ছাই।

কড়াইল বস্তির সরু গলিগুলো আজ খোলা প্রান্তরের মতো লাগছে। কিন্তু সেই প্রান্তর জুড়ে শুধু শূন্যতা আর নিস্তব্ধতা। কেউ কেউ কোনো পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বসে আছে পোড়া কাঠের স্তূপে। কেউবা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী এখন বলছে, এই আগুন শুধু ঘর পোড়ায়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে হাজারো মানুষের ভবিষ্যৎ। এই মানুষগুলোর দিন এনে দিন খাওয়া জীবন; প্রতিদিনের সংগ্রাম, সামান্য স্বস্তি সব পুড়ে গেছে এক নিমেষে। আজ এই ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা জানে না, আজকের দুপুর বা কালকের সকালটা কীভাবে কাটবে তাদের। পোড়া গন্ধ আর ছাইয়ের মধ্যে মিশে থাকা এই দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, কড়াইল বস্তির এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি হাজারো জীবন এবং স্বপ্নের করুণ পরিসমাপ্তি।

এদিকে কড়াইল বস্তির আশপাশের প্রবেশ মুখগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। বেলা ১১টার দিকে অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন নজরুল ইসলাম। এর আগে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে বস্তির বৌবাজারের একটি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় এবং শুকনো মৌসুমের কারণে আগুন দ্রুত শতাধিক ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও, সরু পথ ও পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে মারাত্মক বেগ পেতে হয়। এলাকার লেক থেকে পাইপ টেনে এনে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে।

এএসএস/এমএন