নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে দিনব্যাপী কর্মশালা
আলোচনায় থাকছে নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য ঝুঁকি, সংকট ও সমন্বয়
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুদৃঢ় করা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার কর্মশালা ডেকেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমন্বিত ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালা আগামীকাল বুধবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, দিনব্যাপী আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনলাইনে ভিডিও প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যুক্ত থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ উপস্থিত থাকবেন। এতে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, আইনবিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোট ৮৪৩ জন কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করবেন। আসন্ন নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য ঝুঁকি, সংকট ও সমন্বয়ের ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো কর্মশালায় উত্থাপিত হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
এ কর্মশালায় এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বক্স চৌধুরী, পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম, বিপিএম; প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।
সূত্র থেকে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মশালাটি মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) পূর্বনির্ধারিত ছিল। সবার উপস্থিতি ও সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার স্বার্থেই একদিন পিছিয়ে আগামীকাল বুধবার করা হয়েছে। যদিও এইদিন নির্বাচন-পূর্ব নিরাপত্তা জরুরি সমন্বয় সভা ছিল।
বিজ্ঞাপন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ কর্মশালায় পুলিশ অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা রয়েছে৷ এ প্রেজেন্টেশনে নির্বাচন পূর্ববর্তী, নির্বাচন চলাকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী পুলিশের অবস্থান, কর্মকৌশল, আচরণবিধিসহ নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হবে৷
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, কর্মশালায় উপস্থিত থাকবেন বিভাগীয় কমিশনার ৮ জন, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি ৮ জন, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ৮ জন, জেলা ও দায়রা জজ ৬৪ জন, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ৬৪ জন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬৪ জন, জেলার পুলিশ সুপার ৬৪জন, সব বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সম্পাদক ১২৮ জন, পাবলিক প্রসিকিউটর ৬৪ জন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আঞ্চলিক ও জেলা কর্মকর্তা ৭৪ জন, প্রতি জেলা থেকে ইউএনও বা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) মোট ১২৮ জন। এছাড়া বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড, র্যাব, সিটি পুলিশ, ও আমন্ত্রিত অতিথি মিলিয়ে আরও প্রায় ১৬০ জন কর্মকর্তা থাকবেন। এ ধরনের সমন্বিত উপস্থিতি নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের গুরুত্ব ও প্রস্তুতির প্রতিফলন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট নয়, আস্থার পরিবেশ তৈরিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্থিতিশীল থাকে এবং কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক তৎপরতা আরও সমন্বিত হয় এ লক্ষ্যেই কর্মশালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচিত হতে পারে। এসবের মধ্যে রয়েছে— ভোটকেন্দ্র নিরাপত্তা পরিকল্পনা, কেন্দ্র ভেদে ঝুঁকি মূল্যায়ন, প্রার্থী ও কর্মীদের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ গ্রামীণ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা ঝুঁকির মূল্যায়ন। নিরাপত্তা বাহিনীসমূহের ভূমিকা ও সমন্বয়ের ঘাটতি দূর করতে প্রস্তাবনা থাকবে। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার কার দায়িত্ব কোথায় বা হঠাৎ সহিংসতা হলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কাঠামো নিয়েও আলোচনা হবে।
অন্যদিকে গুজব, অপপ্রচার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে কর্মশালায় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে অনলাইন অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণ, ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় সাইবার টিমের সমন্বিত নজরদারি বাড়ানো। নির্বাচনী অপরাধ মোকাবিলায় দ্রুত বিচার সম্পন্ন। নির্বাচনের আগে ও পরে মামলা বৃদ্ধির প্রস্তুতি। ম্যাজিস্ট্রেটদের মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব। ভোটার উপস্থিতি বাড়ান৷ স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরিতে মাঠপর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় এবং প্রার্থী মনোনয়ন যাচাই ও আইনগত নির্দেশনা নিয়ে কর্মশালায় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। সবশেষে সারাংশ প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব) কাজী শরীফ উদ্দিন বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, ততই রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আস্থা সৃষ্টি। জনগণ যদি মনে করে নিরাপদ পরিবেশ নেই, তাহলে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ে। এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত স্বচ্ছতা ও সময়োপযোগী সমন্বয়।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় কাজ হলো আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে, তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তাই এ ধরনের সমন্বয় সভা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হওয়া জরুরি। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা না থাকলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান।
এ বিষয়ে প্রশাসনিক আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান বলেন, কর্মশালায় বিচারবিভাগের উপস্থিতি প্রমাণ করে নির্বাচন-পরবর্তী মামলার গুরুত্ব। জেলা জজ ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি দেখায়, নির্বাচন-পরবর্তী মামলার চাপ মোকাবিলায় বিচারবিভাগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জেলা ও দায়রা জজ এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো কর্মকর্তাদের উপস্থিতি একটি শক্ত বার্তা দেয়-বিচার বিভাগ নির্বাচনের আইনগত প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ প্রস্তুত।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। তারই অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার আগে এই কর্মশালার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অতীতের মতো যেন বিতর্কিত নির্বাচন না হয় সেজন্য সরকার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিচারবিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের একীভূত সমন্বয়ে একটি ‘ঝুঁকিমুক্ত’ নির্বাচন আয়োজন করার লক্ষ্য। এই ধরনের সমন্বিত প্রস্তুতি নির্বাচনের জন্য ভালো সংকেত। তবে মাঠপর্যায়ে এর বাস্তবায়নই চূড়ান্ত পরীক্ষা।
এমএম/এমএন