চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় তানভীর হোসেন তুর্কি(২৫) নামে এক যুবককে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগে করা মামলায় অভিযুক্ত পুলিশের ৮ কর্মকর্তা-সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মামলায় ফাঁসানোর বিষয়ে যাবতীয় প্রমাণ থাকলেও এসব কানে নেননি তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম ইউনিটের পরিদর্শক বাবুল আকতার। 

যদিও বাবুল আকতার দাবি করেছেন, একই ইস্যুতে আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে। তাই, কাউকে অভিযুক্ত করে আরেকটি মামলায় প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি বাদী কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছেন। এগুলোসহ আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

মামলার প্রতিবেদনে পিবিআই কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, বাদী তার মামলার পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। পাশাপাশি তদন্তে তিনি বিবাদীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা পাননি। তাই তিনি আগের অস্ত্র মামলার কথা উল্লেখ করে আদালতে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন জানান।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিবিআই কর্মকর্তার দাবি সঠিক নয়। অস্ত্র মামলা এবং এই মামলার ইস্যু ভিন্ন। ভুক্তভোগী পক্ষ আদালতে হাজির হয়ে অস্ত্র মামলার কথা উল্লেখ করে দ্বিতীয় মামলাটি করেছেন। বিচারক তা বিবেচনা করেই মামলাটি তদন্তের জন্য দিয়েছেন। 

তানভীর হোসেন তুর্কি(২৫)

অস্ত্র মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ার ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় মাঠে ক্রিকেট খেলছিল একদল যুবক। সেখান থেকে সাদা পোশাকধারী একদল পুলিশ তুর্কিকে আটক করে বিলের মাঝে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় স্থানীয় এলাকাবাসী এগিয়ে এলে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। ঘটনার সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করেছিলেন এলাকার লোকজন। 

পরবর্তীতে পুলিশ তুর্কিকে থানায় নিয়ে গেলে তার ছোট ভাই হিরু হোসেন খোঁজ নিতে যায়। তাকেও আটক করে রাখা হয় থানায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে ছেড়ে দেওয়া হয় হিরুকে। পরদিন থানা থেকে তুর্কিকে আদালতে নেওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠানো হলেও আবার নামিয়ে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে।

এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী যুবকের বড় ভাই রাহাত হোসেন কফিল। এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনও করা হয়। পুরো ঘটনা প্রকাশ পেলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল পুলিশ। 

সাংবাদিক সম্মেলনে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, আটকের পর থানায় নিয়ে তুর্কিকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্বের জেরে পুলিশ দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়েছে। তুর্কিকে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময়ও সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। পরে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার থানায় ঢোকানো হয়। দেড় ঘণ্টা পর আদালতে নেওয়ার জন্য বের করা হলে নির্যাতনের আলামত দেখা যায়। 

পরে এ ঘটনায় ৮ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে অভিযুক্ত করে পাল্টা মামলা করেন ভুক্তভোগীর বড় ভাই রাহাত হোসেন কপিল। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তবে তিনি প্রতিবেদনে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করায় বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তারা তদন্ত করে নভেম্বর মাসে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়।

অভিযুক্তরা হলেন- সাতকানিয়া থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী, এসআই আবদুর রহিম, মোস্তাক আহমেদ, এএসআই রেজাউল করিম, ইকবাল হোসেন, জহিরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন অনিক ও কনস্টেবল কবির হোসাইন।

মামলার বাদী রাহাত হোসেন কফিল দাবি করেন, পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল আকতার আমাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেননি। সাক্ষীর জবানবন্দির বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে তিনি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। বাদী হিসেবে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কেও আমাকে অবগত করা হয়নি। আমি বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।

তিনি আরও বলেন, পিবিআইয়ের প্রতিবেদন আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা এটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।

ঘটনার দিন তুর্কির সঙ্গে খেলছিলেন স্থানীয় আবদুর রহিমের ছেলে মো. রায়হান। তিনি বলেন, আমরা সবাই যখন খেলায় ব্যস্ত, তখন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে খেলার মাঠ থেকে তুর্কিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয়রা বিষয়টিকে তখন সন্ত্রাসী ঘটনা ভেবে তুর্কিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। তখন পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ওই সময় তুর্কির কাছে কোনো অস্ত্র বা গোলাবারুদ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া, খেলার মাঠে কেউ গোলাবারুদ নিয়ে যাবে— পুলিশের এমন হাস্যকর অভিযোগে আমরা হতবাক।

সাইফুল ইসলাম নামে অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ওই সময় তুর্কির কাছে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। দিনের আলোয় খেলার মাঠে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া পুলিশের এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মিথ্যা ও সাজানো ঘটনা। ঘটনাস্থলে এমন কিছু পাওয়া যায়নি। তুর্কিকে থানায় নেওয়ার পর অস্ত্র ও গুলি পাওয়া গেছে বলে প্রচার করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. বাবুল আকতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একই ইস্যুতে আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে। তাই আরেকটি মামলায় কাউকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়। মামলার বাদী কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছেন। আমরা এগুলোসহ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।

এমআর/এমজে