মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যায় ব্যবহৃত সেই ছুরিও ছিল চুরি করা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে চুরি ধরে ফেলায় মা ও মেয়েকে হত্যায় ব্যবহৃত সুইচ গিয়ারটিও ছিল চুরি করা। এই ঘটনার আগে ঘাতক গৃহকর্মী আয়েশা একইভাবে অন্য একটি বাসা থেকে চাকুটি চুরি করেছিল বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ ও একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যবর্তী সময়ে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি বাসায় গৃহিনী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী নাফিসা বিনতে আজিজকে (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে গৃহকর্মী আয়েশা। এ ঘটনায় লায়লার স্বামী আ জ ম আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।
বিজ্ঞাপন
ঘটনার দুই দিন পর ঝালকাঠির নলছিটি এলাকায় দাদা শ্বশুরের বাড়ি থেকে আয়েশা ও তার স্বামী রাব্বি শিকদারকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। পরবর্তীতে আদালতে তোলা হলে আয়েশার ৬ দিন ও রাব্বির তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
বিজ্ঞাপন
রিমান্ড শেষে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা-পরবর্তী সময়ে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আয়েশা। অপরদিকে তার স্বামী রাব্বি দাবি করেছে, সে জানত তার স্ত্রী আয়েশা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মচারী। মা-মেয়ে হত্যার পর রাব্বি প্রথমবার জানতে পারে, তার স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করে।
আদালতে রাব্বি আরও বলেছে, পেশায় সে একজন নিরাপত্তাকর্মী। হেমায়েতপুর এলাকায় রাত্রিকালীন নিরাপত্তার কাজ করে। দিনের বেলা সে ঘুমায় এবং দুই বছরের সন্তানকে দেখাশোনা করে। মোহাম্মদপুরের লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসাকে হত্যার দিন সে ফেসবুকের মাধ্যমে ঘটনাটি দেখেছে। কিন্তু এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর তার স্ত্রী জড়িত— এটা জেনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাব্বি। মা ও মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যার সময় ধস্তাধস্তিতে স্ত্রী আয়েশার হাত কেটে যায়। কাটা হাত নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর ঘটনার বিস্তারিত জেনে প্রথমে তার হাতের চিকিৎসা করায় রাব্বি। পরবর্তী সময়ে স্ত্রীকে নিয়ে সদরঘাট চলে আসে। এই এলাকায় এসে স্ত্রী আয়েশার চুরি করে আনা একটি ল্যাপটপ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। পরে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে বরিশাল যায়। সেখান থেকে ঝালকাঠির নলছিটি এলাকায় দাদাবাড়িতে গিয়ে আত্মগোপন করে।
মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে অভিযুক্ত আয়েশা
মা ও মেয়েকে হত্যায় জড়িত ঘাতক আয়েশা ৬ দিনের রিমান্ডে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) রিমান্ডের চতুর্থ দিন চলছে।
মোহাম্মদপুর থানার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রিমান্ডে থাকা আয়েশা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। দুটি জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় আয়েশা এখন অনুশোচনায় ভুগছে। সে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। রিমান্ড চলাকালে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকায় তাকে বাড়তি নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
হত্যায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক ধারালো সুইচ গিয়ারটির উৎস সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, এই সুইচ গিয়ারটিও চুরি করা। মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে একটি বাসায় একই কায়দায় কাজ নেয় আয়েশা। সেই বাসায় এই চাকুটি পায় সে। পরে এই চাকু ব্যবহার করে ওই বাসার আলমারির তালা ভেঙে ২০ হাজার টাকা চুরি করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ তাকে আটক করে।
চুরি করা টাকা ফেরত দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পায় আয়েশা। যদিও সুইচ গিয়ারটি নিজের কাছে রেখে দেয়। সেই চাকু দিয়েই মা-মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
গৃহকর্মীর আড়ালে পেশাদার চোর আয়েশা
মোহাম্মদপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, আয়েশা গৃহকর্মীর আড়ালে পেশাদার চোর। বিভিন্ন বাসায় কাজ নিয়ে প্রবেশ করে চুরি করত। ২০২৪ সাল থেকে গত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি বাসায় চুরি করেছে। এমনকি তার বোনের বাসা থেকেও নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার চুরি করেছে। এতগুলো ঘটনার মধ্যে মোহাম্মদপুর থানায় একবার সে আটক হয়েছিল।
আয়েশা ও রাব্বির পরিবার সাভারে থাকলেও চুরির সুবিধার্থে আয়েশা জেনেভা ক্যাম্পে ভাড়া থাকত।
ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর ব্লকের একটি বাসায় ভাড়া থাকা অবস্থায় চুরি করে ধরা খায় আয়েশা। সেই বাসা থেকেও তাকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
যা জানালেন তদন্ত কর্মকর্তা
আলোচিত এ জোড়া খুনের মামলা তদন্ত করছেন মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল ওসমান মাসুম। বাসা থেকে চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার দিন বাসা থেকে দুটি ল্যাপটপ, একটি স্মার্টফোন ও একটি বাটন ফোন চুরি হয়। এছাড়া এক জোড়া চুড়ি ও একটি গলার চেইন গায়েব হয়। হত্যার পরে নিহত নাফিসার স্কুল ড্রেস পরে ও ব্যাগ নিয়ে আয়েশা বের হয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হলে আয়েশার স্বামী মোবাইল, নাফিসার স্কুল ড্রেস ও বোরকা ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলে দেন, তাই সেগুলো উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সদরঘাট এলাকায় বিক্রি করে দেওয়া ল্যাপটপটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এর আগে গ্রেপ্তার অভিযানে তাদের কাছ থেকে এক জোড়া চুড়ি ও চেইন উদ্ধার করে জব্দ করা হয়েছে।
এসএএ/এমজে