চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণ, মিল রয়েছে বিদেশি ভেরিয়েন্টের সঙ্গেও
চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণে বিদেশি ভেরিয়েন্টের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এআরএফ) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) নগরের চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
বিজ্ঞাপন
গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া এখন দ্রুত বিস্তারমান একটি মশাবাহিত রোগ। এটি কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বর নয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধির ব্যথা তিন মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছে। গড়ে একজন রোগীর চিকিৎসা ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু (১০ শতাংশ) ও জিকার (১ দশমিক ১ শতাংশ) একযোগে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। নগরের কোতোয়ালী, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় সংক্রমণের মাত্রা বেশি ছিল। উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী ও আনোয়ারায় সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে। ভুল রোগ নির্ণয় ও পর্যাপ্ত রিপোর্টিং না থাকার কারণে প্রকৃত রোগের বোঝা প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে অজানাই থেকে যাচ্ছে বলে গবেষকরা মত দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
এক হাজার ১০০ চিকুনগুনিয়া রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গোড়ালি, হাঁটু, কব্জি ও হাতের অস্থিসন্ধি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে সকালে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া ও ফোলা ভাবের লক্ষণ পাওয়া গেছে। জিনগত বিশ্লেষণে চট্টগ্রামের চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে অর্ধশতাধিক মিউটেশন শনাক্ত হয়েছে, যা আগে পাকিস্তান, ভারত ও থাইল্যান্ডে পাওয়া ভেরিয়েন্টের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
অন্যদিকে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ১ হাজার ৭৯৭ রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ রোগী সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে ভুগছিলেন এবং একটি অংশ গুরুতর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল। বমিভাব, মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেটব্যথা ও ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ উল্লেখযোগ্য হারে পাওয়া গেছে।
জনসংখ্যাগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণরা। শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এবং পুরুষ রোগীর হার নারীদের তুলনায় বেশি। সহ-রোগ হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ ও শরীরে তরল জমে যাওয়ার মতো জটিলতা দেখা গেছে।
গবেষকরা মনে করছেন, শুধুমাত্র ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয়। চিকুনগুনিয়া ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগকে সামনে রেখে সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান।
গবেষক দলে আরও ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. এম এ সাত্তার, ডা. মারুফুল কাদের, ডা. নুর মোহাম্মদ, ডা. হিরন্ময় দত্ত, ডা. ইশতিয়াক আহমদ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডা. এ এস এম লুতফুল কবির শিমুল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. রজত বিশ্বাস, ইউএসটিসির আইএএইচএসের ডা. আয়েশা আহমেদ, এপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ আকরাম হোসেন, নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. অরিন্দম সিং পুলক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের ড. মো. মাহবুব হাসান ও মহব্বত হোসেন এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিকি।
এমআর/এমএসএ