বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পে নিরাপত্তা ও শ্রমিক সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র এখনো উদ্বেগজনক।

২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে জাহাজভাঙা খাতে সংঘটিত দুর্ঘটনা নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছরে অন্তত ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৫৮ জন শ্রমিক আহত ও নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় চারজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৩১ জন এবং হালকা আহত হয়েছেন ১৫ জন। গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব দুর্ঘটনার বড় অংশই ছিল সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), প্রত্যক্ষ শ্রমিকের তথ্য ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা এই গবেষণায় দুর্ঘটনার সময়, ধরন, মাত্রা, পেশাভিত্তিক ঝুঁকি এবং চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সোমবার (২২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের অভিজাত একটি হোটেলে জরিপের প্রতিবেদন তুলে ধরেন বিলসের সেন্টার কো-অর্ডিনেটর জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সদস্য সচিব ফজলুল কবির মিন্টু।

এতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সালে জাহাজভাঙা খাতে মোট ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৫৮ জন শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন চারজন, মারাত্মক আহত হয়েছেন ৩১ জন এবং হালকা আহত হয়েছেন ১৫ জন। চারটি ঘটনায় একাধিক শ্রমিক একসঙ্গে আহত হন। দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনামূলক কম মনে হলেও মারাত্মক আঘাত ও মৃত্যুর হার শিল্পটির ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।

জরিপ অনুযায়ী, মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৬১ শতাংশ ঘটেছে দিনের বেলায়। ভারী লোহার কাজ, কাটিং ও লোডিংয়ের সময় এসব দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে। তবে রাতের বেলায়ও ঝুঁকি কম নয়। মোট দুর্ঘটনার ৩৯ শতাংশ রাতে ঘটেছে, যেখানে আলো স্বল্পতা, শ্রমিকদের অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং পর্যাপ্ত তদারকির অভাব বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

এছাড়া দুর্ঘটনার প্রায় ৬৩ শতাংশই ছিল মারাত্মক। এসব ঘটনায় হাত-পা কাটা বা থেতলে যাওয়া, হাড় ভাঙা, মাথা, চোখ, কান ও বুকে গুরুতর আঘাত এবং আগুন ও বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হালকা দুর্ঘটনার হার ২৯ শতাংশ হলেও মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল মাথায় গুরুতর আঘাত, ভারী লোহার আঘাত এবং ট্যাংকির ভেতরে পড়ে যাওয়া— যার সবকটিই প্রতিরোধযোগ্য বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারী লোহা, লাইনার বা গার্ডার পড়ে আঘাত পাওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে আগুন, গ্যাস ও অক্সিজেন বিস্ফোরণ (২০ শতাংশ)। উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়া এবং ম্যাগনেট, ক্রেন বা যন্ত্রপাতিজনিত দুর্ঘটনা উভয়ই প্রায় ১৫ শতাংশ। কাটিং ও গ্রাইন্ডিং দুর্ঘটনা ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য ছোটখাটো দুর্ঘটনা প্রায় ৫ শতাংশ।

পেশাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কাটার হেলপার, কাটারম্যান, ফিটারম্যান ও ওয়্যার গ্রুপের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। মোট দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশের বেশি এই চারটি পেশার শ্রমিকদের সঙ্গে ঘটেছে। শরীরের কোন অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে পা (৪০ শতাংশ)। এরপর হাত ও আঙুলে ৩০ শতাংশ, মাথা ও মুখে ১৫ শতাংশ, চোখ ও কানে ১০ শতাংশ এবং বুক, কোমর ও ঘাড়ে ৫ শতাংশ আঘাতের ঘটনা ঘটেছে।

দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অধিকাংশ ইয়ার্ডে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাটিং, গ্যাস ও অক্সিজেন লাইনের ত্রুটি, প্রশিক্ষিত শ্রমিকের সংকট এবং সেফটি প্রটোকল না মানার প্রবণতা। রাতের কাজে পর্যাপ্ত আলো ও সুপারভিশনের অভাব পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। বর্ষা মৌসুম ও কাজের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে মে মাসে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল।

আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বাস্তবতা জরিপে সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হিসেবে উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। ফলে ফলোআপ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন তারা।

অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী, আহত শ্রমিক চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এক বছর পর্যন্ত মজুরিসহ ছুটি এবং চিকিৎসার সব ব্যয় মালিক পক্ষকে বহন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। স্থায়ী পঙ্গুত্বের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ এবং জাহাজভাঙা বিধিমালা অনুযায়ী এক বছরের মজুরি পাওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে এসব আইন কার্যকর হচ্ছে না। এর ফল হিসেবে সীতাকুণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে সমাজসেবা বিভাগের দুরারোগ্য রোগ চিকিৎসা সহায়তা ও বিধবাভাতার জন্য অধিকাংশ আবেদন আসে জাহাজভাঙা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে।

সরকারের উদ্যোগে গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড চালু হলেও ২০২৫ সালের দুর্ঘটনা এবং সাম্প্রতিক বড় কয়েকটি ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অবকাঠামো ও প্রযুক্তি উন্নয়ন যথেষ্ট নয় কার্যকর তদারকি, শ্রমিক অংশগ্রহণ এবং নিয়মিত সেফটি অডিট ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জরিপে লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদারের অধীনে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ, রাতের কাজ বন্ধ রাখা, শ্রমিকদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বাস্তবায়ন এবং শিপ রিসাইক্লিং বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। জাহাজভাঙা শিল্প টেকসই করতে হলে প্রথমে শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। 

এমআর/এমজে