কোটি কোটি টাকা ব্যয়, নানা কর্মসূচি আর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও বছরজুড়ে মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ)। নগরবাসীকে ডেঙ্গুর আতঙ্ক আর মশার অসহ্য যন্ত্রণা বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দাদের রীতিমতো ‘নাকানিচুবানি’ খাইয়েছে ডেঙ্গুর বাহক ছোট্ট এই পতঙ্গ। বছরজুড়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েও মশা আটকানো যায়নি। উল্টো পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর মিছিল। সবমিলিয়ে বিশাল বাজেট আর হাঁকডাকের পরও বছর শেষে ‘বিজয়ী’ হিসেবে মশার নামই রয়ে গেল।

ব্যর্থতার বৃত্তে মশক নিধন

বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অথচ সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম কেবল ‘রুটিন মাফিক’ ওষুধ ছিটানোতেই সীমাবদ্ধ। ফলে ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। দিনের বেলায়ও কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সিটি কর্পোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও এখন জনমনে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বাজেটের বিশাল অঙ্ক, নেই ফল

মশা নিয়ন্ত্রণে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মোট ১৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ১১০ কোটি টাকা এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়।

বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। গত এক দশকে মশা মারতে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ডিএনসিসি ৫৬০ কোটি এবং ডিএসসিসি ২৭০ কোটি টাকা খরচ করেছে। 

ডিএনসিসি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১১.৯৫ কোটি), ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩.২৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৬.৮৫ কোটি), ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৯.৩০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫৮ কোটি), ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫০.৫০ কোটি), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫১.৫৩ কোটি), ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫২.৫০ কোটি), ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৪.৫০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৮৭.৫০ কোটি) এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়।

অন্যদিকে, ডিএসসিসি গত ১০ অর্থবছরে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ দেয়। যার মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২.৫০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১.৫০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫.৬০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২.৭৫ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০.০২ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১.০২ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮.৮৩ কোটি টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৪.৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ব্যর্থ সব অদ্ভুত পরিকল্পনা

মশা মারতে প্রতি বছর বাজেটে শত কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় শহরজুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার প্রজননস্থল এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগও নেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল মশা।

মশা মারতে সিটি কর্পোরেশন একসময় রাজধানীর বিভিন্ন খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে— সে লক্ষ্যে ছাড়া হয়েছিল হাঁসও। ধারণা করা হয়েছিল, এসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এছাড়া, জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। অথচ দুই সিটির সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘গতানুগতিক কাজে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সিটি কর্পোরেশনকে বছরজুড়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’

প্রশাসনিক স্থবিরতা ও নেতৃত্বহীনতা

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরসহ শীর্ষ পদে থাকা দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আত্মগোপনে চলে যান। ফলে নগরের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নগরের সেবা অব্যাহত রাখতে তড়িঘড়ি করে সিটি কর্পোরেশনে মেয়রের স্থলে বসানো হয় প্রশাসক। এরপর কয়েক দফায় প্রশাসক পরিবর্তন হয়, অন্যদিকে কাউন্সিলরদের স্থলে দায়িত্ব পান আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, ওয়ার্ড সচিবরা। এরপরও স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম গতি পায়নি। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন চলছে ‘অর্ধেক শক্তিতে’।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির রাজস্ব খাতে অনুমোদিত ৩,১৬৬ পদের মধ্যে ১,৩০৭টি শূন্য। অন্যদিকে, উত্তর সিটির ২,৬৮০ পদের মধ্যে শূন্য ৯১৫টি। ফলে একই কর্মকর্তাকে একাধিক জোনের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে, যা নাগরিক সেবাকে চরমভাবে ব্যাহত করছে।

রাজস্ব আদায়ে ধস

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার প্রভাবে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটির লক্ষ্যমাত্রা ১,৩৩৮ কোটি টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৭১১ কোটি টাকা। উত্তর সিটির ১,৬৩০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১,২৫০ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা; বিশেষ করে মেয়র পদে বসতে টানা আন্দোলনের কারণে কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে।

রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অরক্ষিত নগরী

২০২৫ সালজুড়ে ঢাকা ছিল কার্যত ‘নগরপিতাহীন’। দীর্ঘ ১৬ মাস প্রশাসক দিয়ে চলার কারণে কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে, দক্ষিণ সিটির মেয়রের পদ নিয়ে আইনি লড়াই ও আন্দোলনের ফলে টানা ৪৩ দিন কর্পোরেশনের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল। নেতৃত্বের এই অনিশ্চয়তা ও দায়বদ্ধতার অভাবই ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে।

কাগজে-কলমে হাজারও পরিকল্পনা থাকলেও ২০২৫ সালে সাধারণ মানুষের প্রাপ্তি কেবল মশার কামড় আর ডেঙ্গুর আতঙ্ক। বলা যায়— জনগণ হেরেছে, মশা জিতেছে।

এএসএস/এমএআর