সাভারের আমিনবাজারে নির্মাণাধীন নর্থ ঢাকা ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি ভুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প, যা অবিলম্বে বাতিল করা জরুরি বলে এক গণশুনানিতে দাবি জানানো হয়।

রোববার (২৮ ডিসেম্বর) আমিনবাজারের কোন্ডা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত আয়োজিত গণশুনানিতে বক্তারা এ দাবি জানান।

গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ বাংলাদেশের প্রভাষক এবং আইপিডি এর রিসার্চ ফেলো কে. এম. আসিফ ইকবাল আকাশ, ক্লিনের ক্যাম্পেইন অফিসার মো. নোমান, স্থানীয় বাসিন্দা ড.শাহিন, আল আমিন প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, ঢাকা শহর এরইমধ্যে ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার। এমন বাস্তবতায় ঘনবসতিপূর্ণ আমিনবাজার এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন বর্জ্য পোড়ানোর পরিকল্পনা মানে মানুষের শ্বাস নেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া। এই ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, ডাইঅক্সিন, ফিউরান ও সূক্ষ্ম কণা শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।

ক্তারা আরও বলেন, ঢাকার বর্জ্য এখনো উৎসে পৃথকীকরণ ছাড়াই সংগ্রহ করা হয়। এতে বর্জ্যের আর্দ্রতা বেশি এবং জ্বালানিমান অত্যন্ত নিম্ন। এই ধরনের বর্জ্য দিয়ে কার্যকর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। ফলে প্রকল্পটি শুরু থেকেই প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে।

গণশুনানিতে ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিনের) প্রচারাভিযান কর্মকর্তা মোহাম্মদ নোমান। উপস্থাপিত তথ্যানুযায়ী, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য প্রায় ২৫.৫৬ টাকা, যেখানে বর্তমানে দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকা। অর্থাৎ সরকারকে দ্বিগুণ দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত পড়বে জনগণের কর ও বিদ্যুৎ বিলের ওপর।

ধারনাপত্র অনুযায়ী, ২৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের জন্য সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। যখন দেশ তীব্র ডলার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এমন একটি ব্যয়বহুল চুক্তি গ্রহণ করা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল ও অনিশ্চিত করে তুলবে।

গণশুনানিতে তুলনামূলক বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে যে, আমিনবাজারে স্থাপিত ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চরমভাবে ব্যয়বহুল ও অদক্ষ। প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলার, যেখানে সৌরবিদ্যুতে একই সক্ষমতা তৈরি করা যায় মাত্র ০.৭–১ মিলিয়ন ডলারে। একই অর্থে ২২ গুণেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল। মোট ৪৬৭ মিলিয়ন ডলার রুফটপ সোলারে বিনিয়োগ করলে প্রায় ৯৩২ মেগাওয়াট, গ্রাউন্ড-মাউন্টেড সৌরবিদ্যুৎ থেকে ৪৬৬ মেগাওয়াট এবং বায়ু বিদ্যুতে ৩২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো। এটি প্রমাণ করে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক ও লোকসানমুখী। আইনি ও স্বচ্ছতার দিক থেকেও এ প্রকল্পটি প্রশ্নবিদ্ধ যেমন- পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন ও প্রকাশ করা হয়নি, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়ন অনুপস্থিত, এবং টেন্ডার ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বর্জ্য সরবরাহ ব্যর্থ হলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে জরিমানা দিতে হবে, যা শহরের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলে।

গণশুনানিতে যেসব দাবি উপস্থাপন করা হয় সেগুলো হলো-

১. ঢাকা নর্থ ৪২.৫ মেগাওয়াট ডব্লিউটিই প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

২. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিলম্বের কারণে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্মাণ পরিকল্পনা স্থগিত ও বাতিল করতে হবে।

৩. প্রকল্পের পিপিএ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

৪. AIIB এবং NDB-এর সব অর্থায়ন প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করতে হবে।

৫. ঢাকার জন্য কার্যকর, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং টেকসই ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান এবং রিনিওয়েবল এনার্জি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে।

৬. পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে জনগণের মতামত ও সম্মতি বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে।

৭. ভবিষ্যতে কোনো বিদ্যুৎ বা অবকাঠামো প্রকল্পে টেন্ডার ও স্বচ্ছতার নিয়ম এড়ানো যাবে না; সব প্রক্রিয়া জনস্বার্থ ও জবাবদিহির ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে হবে।

ওএফএ/জেডএস