করোনাকালে শিশুবিবাহের ঊর্ধ্বগতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
ইউনিসেফের হিসেব মতে, বাংলাদেশের ২০-২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের ৫১ ভাগেরই ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে থাকে। শিশুবিবাহের এ প্রবণতা করোনাকালে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে ইউনিসেফসহ অনেক সংস্থাই আশংকা প্রকাশ করেছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও ইউএন উইমেন মিলে সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণাটিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৬,৩৭০টি খানায় জরিপ পরিচালনা করে ১৫০টি শিশুবিবাহের ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেসব ঘটনার মধ্যে ৩৯ ভাগ ক্ষেত্রেই কনের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে এবং ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে ১৬ বছরের নিচে। ১৮ বছরের আগে (যদিও সংশোধিত আইনে বিশেষ কারণে ১৬ বছর গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত) কন্যা শিশুর বিয়ে আইনসিদ্ধ নয় বলে উত্তরদাতারা সাধারণত কনের বয়স বাড়িয়ে বলেন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জরিপে আরেকটি প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল—বিয়ের সময় মেয়েটি কোন শ্রেণিতে পড়ত। সে তথ্য ধরে হিসেব করে দেখা গেল—বিয়ের সময় ৭৭ শতাংশ কনের বয়স ছিল ১৮ বছরের কম এবং ৬১ শতাংশের ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম। গ্রামাঞ্চলে এ হার আরও বেশি (৮১ শতাংশ ১৮ বছরের নিচে এবং ৬৪ শতাংশ ১৬ বছরের নিচে)। এ তথ্য সহজেই বলে দেয় যে, বিদ্যালয় ও কলেজগামী অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীকে করোনাকালে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে; যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশিই বলে প্রতীয়মান হয়।
বিজ্ঞাপন
শিশুবিবাহের এ ঊর্ধ্বগতির পেছনে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বিদ্যালয়ে সরাসরি পড়াশোনা না হওয়ায় সারাদিন ঘরে বসে থাকা কন্যা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকার কথা বলেছেন অনেক অভিভাবক। বিকল্প হিসেবে তারা বিয়েকেই বেছে নিয়েছেন। এর ফলে বিদ্যালয় খুললে এই শিশুদের আর নতুন করে বিদ্যালয়ে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ফলস্বরূপ, কন্যা শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার যে বৃদ্ধি পাবে তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। সেটি ঘটলে কন্যা শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার হার কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের যে অর্জন তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
কন্যা শিশুদের পাশাপাশি ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে আশংকার কথা হলো দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে। তাদের পিতা-মাতার কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার কারণে শিশুদের কাজে অর্থাৎ ছোটখাট উপার্জনের কাজে লাগানো হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ছেলে শিশুদের এই অংশটিও বিদ্যালয়ে ফিরতে পারবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ থেকে যায়।
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ প্রতিরোধে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় অর্থাৎ লাগাতার বন্ধ রাখার বিষয়টি একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। শহরের শিশুরা অনলাইন ক্লাসের কিছুটা সুফল পেলেও গ্রামের শিশুদের জন্য একমাত্র পথ খোলা ছিল সংসদ টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাস। ব্র্যাকের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী (বাংলা মাধ্যম ও মাদরাসায় পড়ুয়া) টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাসগুলো অনুসরণ করে না এবং নানা কারণেই সেসব ক্লাসের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে অভিগম্যতার বিষয়টিও বড় আকারে পরিলক্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ অনেকের বাড়িতে টেলিভিশন বা কেবল নেটওয়ার্ক নেই। অন্যদিকে, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এ ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার মতো কারিগরি সক্ষমতা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নেই বললেই চলে। ফলে, শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর নেই।
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়—ইবোলা মহামারির ফলে লাইবেরিয়ায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছিল। যথাযথ বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে আমাদের দেশেও ঝরে পড়ার হার এর চেয়ে বেশি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আবার যেসব ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে ফিরবে তাদের মধ্যেও এক ধরনের শেখার ঘাটতি তৈরি হবে, যা তাদের শিক্ষা জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তৈরি করবে। আরেকটু খোলাসা করে বললে বলা যায়—গত এক বছরে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে শিখন-দক্ষতা বা সক্ষমতা তৈরি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। কারণ, স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা অনুপস্থিত ছিল। আর গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল বলা চলে। ফলে, গ্রামাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে শিখন-দক্ষতার ঘাটতি ব্যাপকভাবে অনুভূত হবে। ভবিষ্যতে এ ঘাটতিই গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে অসমতা তৈরি করবে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে।
করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আসায় শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিকল্প না ভেবে এ অবস্থা চলতে থাকলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও ঘনীভূত হবে। তাই কয়েকটি ধাপে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। প্রথমত, যেসব জেলায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের কম সেসব জেলায় বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যেসব জেলায় সংক্রমণের হার এখনও বেশি সেখানে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় উপকরণ দিতে হবে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশের কথা ভেবেই এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
এ এস এম জুয়েল: উন্নয়ন গবেষক। বর্তমানে ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জ বিভাগে টিম লিড – রিসার্চ অ্যান্ড এভিডেন্স হিসেবে কর্মরত।
এনএফ