চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড

তীব্র ছোঁয়াচে ভাইরাস করোনা। আর তাইতো এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে থাকতে হয়। তাছাড়া রোগী থেকে সুস্থদের দূরে থাকতে হয়। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডেও রোগীর স্বজনদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। 

কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা মিলল ভিন্ন চিত্র। সোমবার (৫ জুলাই) সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত করোনা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, অবাধে প্রবেশ করছেন রোগীর স্বজনরা। আবার সেখান থেকে বের হয়ে তারা নিজেকে স্যানিটাইজ না করেই মিশে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। 

দেখা গেছে, এ ওয়ার্ডের গেটে দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র একজন আনসার সদস্য। এক ঘণ্টার মধ্যে তার উপস্থিতি ছিল মাত্র বিশ মিনিটের মতো। বাকি সময় তিনি কোথায় ছিলেন তা জানা যায়নি। তার বর্তমানে-অবর্তমানে রোগীর স্বজনরা ওয়ার্ডে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি শিশু কোলে নিয়েও একজনকে ঘুরতে দেখা গেছে।    

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা ওয়ার্ডে এভাবে অবাধে প্রবেশ এবং পরে সাধারণের সঙ্গে মেশার ফলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ছে। তবে, এ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। কেন অবাধে ওয়ার্ডে প্রবেশ করে আবার বের হয়ে যাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা নানা অজুহাত দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার এড়িয়ে যাচ্ছেন। 

করোনা ওয়ার্ডের বাইরে অবস্থানকালে কথা হয় নগরের দেওয়ানহাট থেকে মাকে নিয়ে আসা নাদিমের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের সেবায় আমি সন্তুষ্ট। করোনা ওয়ার্ডের বাইরে কেন এসেছেন- এ প্রশ্ন করতেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তিনি।  

ফটিকছড়ি থেকে মাকে নিয়ে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে এসেছেন আনোয়ার (ছদ্মনাম)। তার মা এখানে চার দিন ধরে ভর্তি। তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, সকালের নাস্তার জন্য তিনি বাইরে বের হয়েছিলেন। নাস্তা শেষ করে তিনি আবার এখানে এসেছেন। তিনি জানান, ভেতরে প্রবেশ করার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। হাসপাতালের চিকিৎসা বেশ ভালো বলেও জানান তিনি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোগীর এক স্বজন অভিযোগ করেন, এখানে করোনা রোগীরা ঠিকমতো চিকিৎসা পান না। চিকিৎসক ও নার্সরা সহযোগিতা করেন না। 

করোনা ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের অবাধে আসা-যাওয়া

করোনা ওয়ার্ডের বাইরে বসে ছিলেন কামাল আহমেদ। তার ভাইয়ের স্ত্রী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি আট দিন ধরে। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা কিছু পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আমরা এগুলো বাইরে থেকে করিয়ে এনেছি। কিছু ওষুধ বাইরে থেকেও আনা হয়েছে। কামালের সঙ্গে কথা বলার সময় তার ভাতিজা করোনা ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসেন। ওষুধ বিষয়ে ভাতিজা কামালের সঙ্গে কথা বলেন। বাইরে থেকে ওষুধ কিনে দুজনই একসঙ্গে ফের ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন।  

সকাল দশটার মিনিটের দিকে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে করোনা ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেখা যায় এক তরুণকে। মিরসরাই থেকে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, জরুরি বিভাগে আসার পর সেখান থেকে হাসপাতালের কর্মীদের সহায়তায় বাবাকে করোনা ওয়ার্ডে নিয়ে আসছি। তাকেও বাইরে-ভেতরে আসা যাওয়া করতে দেখা গেছে।

করোনা ওয়ার্ডে অবাধে আসা-যাওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ওয়ার্ডে অবাধ বিচরণের ঘটনাটি ঠিক আছে। মানুষ যদি নিজেরা সচেতন না হয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আনসার সদস্যের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে আনসার সদস্যের সংখ্যা সীমিত। করোনা ওয়ার্ডে পালা করে একজন আনসার দায়িত্ব পালন করেন। 

এতে করোনার ঝুঁকি বাড়ছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যিনি করোনা ওয়ার্ডে যাচ্ছেন, তিনিও কিন্তু ঝুঁকিতে পড়ছেন। আমরা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে পারছি না। সাধারণ মানুষের অবাধ প্রবেশ বন্ধ করার মতো নিরাপত্তা কর্মীও আমাদের নেই। একজন আনসার দিয়ে হচ্ছে না। তারপরও অবাধে প্রবেশের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, করোনা ওয়ার্ডে কাউকে অবাধে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া যাবে না। রোগীর স্বজনরা ইচ্ছেমতো আসা-যাওয়া করলে তো হবে না। এ ওয়ার্ডে অবাধ চলাফেরা থাকলে সংক্রমণ লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, করোনা ওয়ার্ডে প্রবেশ করে রোগীর সংস্পর্শে এসে স্বজনরা বাইরে সবার সঙ্গে মিশছেন, আড্ডা দিচ্ছে, বিষয়টি তো ভয়াবহ। এভাবে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে না। হয়তো হাসপাতালে ভর্তি রোগী ভালো হবে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে না। তাই হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে হবে।

করোনা ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের অবাধে আসা-যাওয়া

ওষুধ ও পরীক্ষা বাইরে হয় কি না - এমন প্রশ্নের জবাবে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা.সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যেসব ওষুধ হাসপাতালে থাকে, সেগুলো রোগীদের দেওয়া হয়। সবসময় সব ওষুধ থাকে না। তখন হয়তো রোগীদের কিছু ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। বেশিরভাগ ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। 

তিনি আরও বলেন, করোনা সম্পর্কিত সব পরীক্ষা চমেক হাসপাতালে হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রোগীকে চমেকেই পরীক্ষা করাতে বলি। কিন্তু রোগীর স্বজনরা বাইরে গিয়ে পরীক্ষা করে নিয়ে আসেন। এছাড়া,  অনেকে হাসপাতালে আসার সময় পরীক্ষা করে নিয়ে আসেন। বেশিরভাগ রোগীই এখানে চিকিৎসা নেন।

করোনা ইউনিটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে করোনা পজিটিভ রোগী ভর্তি আছেন ১২৩ জন, করোনা সাসপেকটেড হিসেবে ভর্তি আছেন ৬৫ জন। ১০টি আইসিইউর পাঁচটিতে রোগী ভর্তি আছেন। 

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ২০৬টি  শয্যা আছে। এখানে বর্তমানে ১৮টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ২৪টি ক্যানোলা নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো চালুর জন্য চেষ্টা চলছে।

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে হাসপাতালে থাকা যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসক দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব জিনিস জরুরি ভিত্তিতে দরকার, তার জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। আরও  হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।
 
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫৯ জন। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পাঁচজন।

কেএম/আরএইচ