দেশের প্রথম মেট্রো রেলপথ হচ্ছে রাজধানীতে। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। একের পর এক খুঁটির ওপর বসছে স্ল্যাব। রেলপথ বসানোও শুরু হয়েছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) অধীনে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ডিএমটিসিএলের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬৮ শতাংশ। মতিঝিল থেকে রেলপথ বর্ধিত করা হবে কমলাপুর পর্যন্ত। সব মিলিয়ে রেলপথটি হবে সাড়ে ২১ কিলোমিটার।

এরই মধ্যে জাপান থেকে তৈরি করা দুটি ট্রেন সেট প্রকল্পের দিয়াবাড়ি এলাকায় এসেছে। এই ট্রেন চালাতে সরাসরি চালক প্রয়োজন হবে না। চলবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। চালক দূর থেকে ট্রেন নিয়ন্ত্রণ করবেন। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ট্রেনকে নিরাপদে নিয়ে যাবেন চালক। চালকের মুখ্য কাজ হবে ট্রেনের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খেয়াল রাখা। আর ট্রেন চলবে সময়সূচি অনুসারে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের অধীনে প্রথম ট্রেন চালক হিসেবে নিয়োগ পান নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিম। ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে তাকে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। আরও ৩০ জন চালকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরপর আরও এক দফা চালক নিয়োগ করা হবে। ট্রেন থাকবে ২৪টি। তার দ্বিগুণ চালক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ১০ শতাংশ চালক নিয়োগ দেওয়া হবে। অতিরিক্ত এই চালক নিয়োগ দেওয়া হবে সংরক্ষিত (রিজার্ভ) হিসেবে।

নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিমের নিয়োগের পর থেকে তার শিক্ষানবিশ পর্ব শুরু হয়েছে। আগামী ২১ আগস্ট তার শিক্ষানবিশকাল শেষ হচ্ছে। তার বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। থাকছেন মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপো এলাকার অদূরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে।

সোমবার (৫ জুলাই) বিকেলে দিয়াবাড়ি এলাকায় নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিমের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রথম চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা খুব গর্বের বিষয় আমার কাছে। দেশে নতুন প্রযুক্তির নতুন ট্রেনে প্রথম চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। সেই খুশির রেশ এখনও আছে।

তিনি বলেন, দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মেট্রোরেল চলবে। আমি নিয়োগ পাওয়ার পর এ পর্যন্ত যেসব প্রশিক্ষণ নিয়েছি, তাতে জানতে পেরেছি, মেট্রোরেলে ট্রেনের চালক থাকবে। কিন্তু তার কাজ ট্রেন চালানো নয়। কনভেনশনাল ট্রেনগুলো যেভাবে চালানো হয়, সেভাবে মেট্রোরেল চালানো হবে না। মেট্রোরেলের চালক মনিটরিং করবেন। যেমন ট্রেনে সবকিছু ঠিকমতো আছে কি না, প্যাসেঞ্জার ক্যাবে সিসি ক্যামেরা থাকবে। তিনি সিসি ক্যামেরায় দেখতে পাবেন প্যাসেঞ্জার ক্যাবে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। ট্রেনের বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা থাকবে। সেগুলো থেকে তিনি বুঝতে পারবেন, ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা সমস্যা তৈরি হচ্ছে কি না। তিনি দেখবেন, গ্যাসের চাপ ঠিক আছে কি না বা ট্রেনের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না। ট্রেন চলবে ওসিসি বা অপারেশন কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে। মেট্রোরেল চলতে চলতে ওসিসির সঙ্গে কখনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে চালক ট্রেনটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় এটিপি বা অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন।

ট্রেন চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিমের। তিনি প্রতিনিয়তই শিখছেন। হাকিম বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আমাকে কয়েকটি প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। আমার সঙ্গে স্টেশন কন্ট্রোলাররাও ছিলেন। প্রথম প্রশিক্ষণ ছিল ফাউন্ডেশন ট্রেনিং। এরপর আমাদের চট্টগ্রামের হালিশহরে অবস্থিত রেলওয়ে একাডেমিতে পাঠানো হয়। সেখানে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং ছিল দুই মাসের। এরপর রেলওয়ে একাডেমির প্রশিক্ষণ কোর্সও ছিল দুই মাসের। পরে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানিতে ফিরে আসি। কোম্পানির একজন প্রশিক্ষণ পরিচালক আছেন, তার তত্ত্বাবধানে এখন প্রশিক্ষণ চলছে।

তিনি বলেন, এখন আমার শিক্ষানবিশকাল চলছে। মেট্রোরেলের ট্রেনে আমার কাজ কী হবে তা নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। করোনাকালের ফলে এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছি অনলাইনে। তবে মূল প্রশিক্ষণ হবে ভারতে। আমি ছাড়াও এতে অংশ নেবেন স্টেশন কন্ট্রোলাররা। আমার কাছ থেকে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ পাসপোর্ট নিয়েছে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রশিক্ষণটি শুরু হচ্ছে না। শুনেছি এটা ছয় মাসের প্রশিক্ষণ হবে। তবে কর্তৃপক্ষ এখনো আমাকে চূড়ান্ত কিছু জানায়নি।

মেট্রোরেলের দুটি ট্রেন সেট এসেছে। এগুলোর পরীক্ষামূলক চলাচল শুরুর আগে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিছু সহকর্মী এসব কাজে সম্পৃক্ত আছে বলে জানালেন নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মেট্রোরেলের যেসব ট্রেন সেট আসছে, সেগুলোর প্রতিটিতে ছয়টি করে বগি থাকছে। থাকছে ট্রেইলার কার। ট্রেইলার কার ট্রেনকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ট্রেন ঘোরানোর দরকার হবে না। ট্রেইলার কার দুটি থাকবে দুই প্রান্তে। একটি নিয়ে যাবে, আরেকটি ফেরার পথে ট্রেনকে টেনে আনবে। ট্রেনের গতিবেগ ১০০ কিলোমিটার। তবে ঢাকায় এক বা দেড় কিলোমিটার পর পর রেলস্টেশন থাকবে। ফলে গতিবেগ কম হবে। মেট্রো ট্রেনের মধ্যস্থলের কারগুলো মূলত মোটরকার। এসব কারে চড়বেন যাত্রীরা। সব মোটর কার মিলে একটি ট্রেনে ১৭৮৩ জন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।

খুলনার ছেলে নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিমের বাড়ি শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে, সুন্দরবনের কাছে। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়শোনা করেছেন। ২০১৯ সালে অনার্স শেষ করে চাকরির সন্ধান শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি সংবাদপত্রে ডিএমটিসিএলের দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৫২ জন ট্রেন অপারেটর বা চালক ও ৬৭ জন স্টেশন কন্ট্রোলার নিয়োগের কথা বলা হয়।

তিনি বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আমার আগ্রহ হয়। ভালো লাগে এ কারণে যে দেশে নতুন প্রযুক্তির ট্রেন আসছে। মেট্রোরেলে কাজ করার সুযোগ হয়ত পাওয়া যাবে। তখন আমি আবেদন করি। কয়েক ধাপে পরীক্ষা হয়। প্রথমে লিখিত পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা নেয় মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)। এরপর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আমাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেয়। চার ধাপে প্রক্রিয়া শেষ হলে নিয়োগ পাই। মেট্রোরেলের আমিই প্রথম ও একমাত্র নিয়োগপ্রাপ্ত ট্রেন চালক। আরও ৩০ ট্রেন অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হবে। এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। 

ডিএমটিসিএল'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেট্রোরেলের ট্রেন পরিচালনার জন্য ৪৮ জনের বেশি চালক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে আরও ৩০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারা উত্তীর্ণ হলে নিয়োগ দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রথম দিকে চালক রাখা হবে। এ চালকদের কাজ হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা ট্রেনের সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। কোচের দরজা বন্ধ না হলে ট্রেন চলবে না। এ দরজা বন্ধ হলো কিনা, প্লাটফর্মে ও স্টেশনে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা তা-ও খেয়াল রাখবে চালকরা। স্টেশন কন্ট্রোলার ও মেট্রোরেল পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে চালকের যোগাযোগ থাকবে। পরিস্থিতি অবহিত করবে। কোনো প্রয়োজন হলে স্টেশন কন্ট্রোলার ও পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলবে। ট্রেনে যাতায়াতের বিষয়ে যাত্রীদের অভ্যাস গড়ে উঠলে চালকের আর দরকার হবে না।

এসএসএইচ