গ্রেফতার ইফতেখার ফারদিন দিহান

‘ঘটনার দিন দুপুর ১২টা ১৯ মিনিটে আনুশকা আমাকে তার মোবাইল থেকে ফোন করেছিল। ইফতেখার ফারদিন দিহান এবং তার বন্ধুরা যখন আমার মেয়েকে নির্যাতন করছিল তখন মেয়েটা আমার বাঁচার জন্য ফোন করে। কিন্তু মিটিং থাকায় আমি কল রিসিভ করতে পারি নাই। এটাই ছিল ভুল। কল রিসিভ করতে পারলে পরিস্থিতি আজ ভিন্ন হতো।’

রোববার (১০ জানুয়ারি) মেয়ে হারানোর বেদনায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলেন আনুশকার বাবা মো. আল আমিন।  

গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলবাগানে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনকে ধর্ষণ করেন ইফতেখার ফারদিন দিহান। ধর্ষণের পর গোপনাঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আনুশকার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার মামলায় দিহান গ্রেফতার রয়েছেন। তিনি ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানন্দিও দিয়েছেন।

এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন আনুশকার বাবা মো. আল আমিন-

‘১২ টা ১৯ মিনিটে আনুশকা আমাকে ফোন দেয়’
ঘটনার দিন বেলা ১২ টা ১৯ মিনিটে আনুশকা আমাকে ফোন দেয় তার মোবাইল থেকে। তখন আমি একটা মিটিংয়ে থাকায় কল কেটে দেই। পরে নানা ব্যস্ততার কারণে তাকে কলব্যাকও করতে পারিনি। আমার এখন মনে হচ্ছে আনুশকা যখন কোচিংয়ে যাচ্ছিল তখন হয়তো দিহান তিন বন্ধুকে নিয়ে তাকে রাস্তায় বাধা দিচ্ছিল। আনুশকাকে যখন তারা নির্যাতন করছিল তখন সে আমাকে ফোন দেয়। ফোনটা না ধরাই ছিল সব থেকে বড় ভুল। আমি যদি ফোনটা রিসিভ করতে পারতাম, তাহলে আমার মেয়ে তাকে নির্যাতন বা রাস্তায় বাধা দেওয়ার কথা বলত। তখন আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ঘটনা এত দূর আসত না। আর আমি মিরপুরে ছিলাম, এমন কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে পারতাম। আমার মেয়েকে তারা প্রেসারাইজড করেছে, না হলে আমার মেয়ে ওইদিকে যাওয়ার কথা না। আমি এসব কথা পুলিশকেও জানিয়েছি।

দিহানের তিন বন্ধুকে কেন সন্দেহ করছে আনুশকার পরিবার?
এ বিষয়ে আনুশকার বাবা মো. আল আমিন বলেন, তাদের সন্দেহ করার কারণ হলো, আনুশকাকে হাসপাতালে নিয়ে দিহান আমার স্ত্রীকে ফোন দেয়। আমার স্ত্রী বলেছিল তোমরা কয় জন আছ? দিহান জানিয়েছিল তারা চার জন আছে। আনুশকার মা যখন হাসপাতালে যায় তখনও দিহানসহ তার তিন বন্ধুকে দেখতে পায়। ওইদিন দিহান প্রথম ফোনটা আমার স্ত্রীকে তার বাসা থেকে করেছিল। আনুশকা তখন অচেতন হয়ে পড়েছিল। তখনও সে বলেছে বাসায় দিহান ও তার তিন বন্ধু রয়েছে। এছাড়া আমার মেয়েকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। 

আনুশকার বাবা বলেন, ঢামেক হাসপাতালের অনেক পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি একজনে এই কাজটা করে নাই।  তাকে নানানভাবে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এখন এসে বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি দিহানের তিন বন্ধুও জড়িত আছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। এছাড়া দিহানের তিন বন্ধুর মধ্যে একজনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। সে কোথায় থেকে এসেছে এবং কেন এসেছে? কিন্তু এখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

দিহানের তিন বন্ধু জড়িত থাকার সন্দেহ করলে মামলার এজাহারে কেন শুধু দিহানের নাম? 
এই প্রশ্নের জবাবে আনুশকার বাবা বলেন, মামলার এজাহার যখন লেখে তখন আমি বলেছিলাম চার জনকেই আসামি করা হোক।  মামলার সময় পুলিশ আমাদের বলেছিল বাকি তিন জনকেও তারা আসামি করতে পারে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর ওদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। তখন আমিও দেখলাম ঠিকই আছে। তারা যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে কেন আসামি করা হবে? একটা ছেলের জীবন তো শুধু শুধু নষ্ট করা যায় না। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আসার আগেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু ঘটনাস্থলে তারা চার জন ছিল বলে দিহান ফোনে বলেছিল। মামলা করার পর বুঝলাম। এই বিষয়ে আসলে আমি আগে কিছুই জানতাম না। পরে অনেক তথ্য জানতে পেরেছি।

মামলার করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করেছিলেন আনুশকার বাবা?
এ বিষয়ে ভিকটিমের বাবা বলেন, ঘটনার দিন আমাদের সময়টা নষ্ট হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমাদের প্রথমে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের কাগজ তৈরি করতে। কাগজপত্র তৈরি করতে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঢামেক হাসপাতাল থেকে আসতে দেরি হয়ে যায়। আর এই কারণে কলাবাগান থানায় আমরা মামলা করার জন্য খুব বেশি সময় পাইনি। কিন্তু ময়না তদন্ত হয়েছে এর পরের দিন বিকেলে। এখন মনে হচ্ছে, ঢামেক হাসপাতালে বেশি সময় লাগার পিছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। 

তিনি বলেন, আমরা যদি ঘটনার পরের দিন মামলাটা করতে পারতাম তাহলে বাকি তিন জনকেও অভিযুক্ত করা যেত। তবে তাদের ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই এত দ্রুত ছেড়ে দেওয়া হবে তা আমরা বুঝতে পারি নাই। কেননা পুলিশ তখন বলেছিল, একজনের নামে মামলা হলেও বাকিরা জড়িত থাকলে তাদের আসামি করা হবে।

দিহান ও তার তিন বন্ধু আইনি প্রক্রিয়ায় কি বেশি সুবিধা পাচ্ছেন?
এ বিষয়ে আনুশকার বাবা বলেন, আমার মনে হচ্ছে তারা বেশ কিছু বিষয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। কেননা ময়নাদন্তের কাগজ তৈরি করতে কালক্ষেপণ ও দ্রুত ওই তিন জনকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আমাদের মনে সন্দেহ তৈরি করছে। এছাড়া আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি তারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

পুলিশ যা বলছে
ভিকটিমের বাবার এসব অভিযোগের বিষয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার আবুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার বাদী তো আনুশকার বাবা নিজেই। তিনি তার আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে মামলাটি করেছেন। তাহলে এখন কেন এসব অভিযোগ করছেন বুঝতে পারছি না।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন সঙ্গে সঙ্গে আমরা  দিহান ও তার তিন বন্ধুকে আটক করি। তাদেরকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মোবাইল প্রযুক্তিগত পরীক্ষা করা হয়েছে। পরে মুচলেকা দিয়ে  দিহানের বন্ধুদের ছাড়া হয়। মামলাটি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে যখন প্রয়োজন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আনুশকার মা-বাবাকে আমরা দ্রুত ডাকব। তাদের অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা শুনব। পুলিশ নিরপেক্ষভাবে মামলার তদন্ত করে যাচ্ছে। কাউকে বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। 

উল্লেখ, গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে ডলফিন রোডে নিজ বাসায় নিয়ে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিন ওরফে শাহনূরীকে ধর্ষণ করেন দিহান। পরে আনুশকা অচেতন হয়ে গেলে তাকে কলাবাগানের আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপালে নিয়ে যান দিহান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক আনুশকাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় দিহান ও তার তিন বন্ধুকে আটক করে পুলিশ।

ঘটনার দিন রাতে কালবাগান থানায় দিহানকে আসামি করে মামলা করেন আনুশকার বাবা মো. আল আমিন। আনুশকাকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ২ ধারায় মামলাটি করা হয়। পরেরদিন শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) দিহানকে আদালতে তোলা হলে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এদিকে শুক্রবার বিকেলে আনুশকার মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেসনিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আনুশকার মৃত্যু হয়েছে। তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ দুই দিক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ময়নাতদন্তে দেহের দুই অংশেই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে ধস্তাধস্তির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।

চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না তা জানার জন্য নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। ঘটনাস্থলে একাধিক ব্যক্তি ছিল। তাদের ডিএনএ নমুনা এবং ভিসেরাও সংগ্রহ করা হয়েছে।

ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকায় শুক্রবার রাতে দিহানের তিন বন্ধুকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এমএসি/এইচকে