কারওয়ান বাজার কামারপট্টি : ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি
কোরবানির ঈদ এলেই ব্যস্ততা বাড়ে কারওয়ান বাজারের কামারপট্টিতে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কয়লার আগুনে লোহা পুড়িয়ে তাতে হাতুড়ি পেটা করে দা, বটি, ছুরি ও চাপাতি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কামাররা। কিন্তু যাদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে এসব মালামাল তৈরি, সেই ক্রেতার দেখা মেলছে না। ঈদের মাত্র তিন দিন বাকি থাকলেও বেচাকেনা না থাকায় দোকানিদের অলস সময় কাটছে। তবু তারা আশা করছেন, দুএকদিনের মধ্যেই বাজার কিছুটা হলেও চাঙা হবে।
জানা গেছে, কারওয়ান বাজার কামারপট্টিতে ১২টি দোকানে কামাররা দা, বটি, ছুরি ও চাপাতি তৈরি করছেন। তাদের তৈরি এসব পণ্য বিক্রি হয় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৩টি দোকানে। সাধারণ একজন কামারের সঙ্গে দুই থেকে তিন জন হেলপার থাকে। আর দোকানগুলোতে ঈদ মৌসুমে তিন থেকে চার জন লোক কাজ করেন। সব মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান রাজধানীর এই কামারপট্টিতে। কিন্তু বেচাকেনা কম হওয়ায় সবার চোখেমুখে হতাশার চাপ।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর এই কামারপট্টিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কামারদের তৈরি পণ্যের বাজারটিতে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতাই এখন বেশি। দোকানগুলোতে ছোট-বড় ছুরি, চাপাতি, দা-বঁটির পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ক্রেতার আনাগোনা না থাকায় দোকানিরা কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা টুলে বসে ঝিমচ্ছেন। দোকানের সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই ক্রেতা ভেবে হাঁকডাক দিচ্ছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
দোকানিদের দাবি, করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছরে মানুষের আয় এমনিতেই কমে গেছে। এর মধ্যে এবার ঈদের আগ মুহূর্তে সারাদেশে ‘লকডাউন’ ছিল। ফলে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কেউ আবার চাকরি করলেও বেতন পাচ্ছেন না। সবকিছু মিলিয়ে মানুষের কাছে টাকা নেই। তাই এবারের ঈদে কোরবানি দাতার সংখ্যাও কমবে। তাই তাদের তৈরি পণ্যের এই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে মানুষের আয় কমে যাওয়া অনেকে নতুন ছুরি, চাপাতি, দা, বটি না কিনে পুরাতনগুলোকে শান দিয়ে কোরবানির জন্য তৈরি করছেন।
একটি দোকানের সামনে ছোট টুলে বসেছিলেন মো. সোহাগ। দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘মামা কী লাগবে? দেখেন সব ধরনের ছুরি, চাপাতি আছে। ভেতরে আসেন।’
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ব্যবসার অবস্থা জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, এ বছর ব্যবসার অবস্থা ভালো না। গতবছর ঈদের পাঁচ দিন আগে থেকেই প্রতিদিনই ৩০ হাজার টাকার বিক্রি হতো। এ বছর তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ এ বছর করোনার কারণে মানুষের কাছে টাকা নেই। তাই কোরবানি দিতে পারছে না। কোরবানি দিতে না পারার কারণে ছুরি, চাপাতিও কিনছে না।
গত বছর তো দেশে করোনার মধ্যে কোরবানি হয়েছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে সোহাগের যুক্তি, গত বছর করোনা মধ্যে ঈদ হলেও তখন মানুষের কাছে জমানো টাকা ছিল। কোরবানি দিতে পেরেছে। কিন্তু এ বছর তো সেটা করতে পারছে না। আগে যেসব ব্যবসায়ী চার-পাঁচটি গরু কোরবানি দিতো, তারা এ বছর এ-দুইটির বেশি দিচ্ছে না। ফলে তাদের ছুরি, চাপাতির চাহিদাও কম।
কামার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লোহার মানের ওপর ভিত্তি করে তাদের তৈরি করা পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। রেলের স্পিং পাতি লোহার মান সবচেয়ে ভালো। এ লোহার এক কেজি ওজনের চাপাতি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর গাড়ির লোহার তৈরি এক কেজি ওজনের চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়, কাঁচা লোহা দিয়ে তৈরি এক কেজি ওজনের চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। এর বাইরে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে মাংস কাটার ভালো চুরি, ৮০০ টাকা থেকে এক হাজারের মধ্যে গরু জবাইয়ের ছুরি পাওয়া যাচ্ছে। হাড় কাটার দেশি কুড়াল পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ টাকায় এবং চাইনিজ কুড়াল পাওয়া যাচ্ছে ৪০০ টাকায়। এছাড়া দা-বঁটির পাশাপাশি আরও কয়েক রকমের ছুরি পাওয়া যাচ্ছে।
ভোলা সদর কর্মশালের মালিক আমির হোসেন জানান, লোহার দাম বাড়লেও তৈরি পণ্যের দাম বাড়েনি। বরং ক্রেতা না থাকায় কাস্টমার ছেড়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকে কম লাভে বিক্রি করে দিচ্ছে।
আমির হোসেন জানান, রেলের লোহার এক কেজি ওজনের চাপাতি এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়, যেটা আগে বিক্রি হতো ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। কিন্তু এবার ক্রেতা কম থাকায় কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আগে যে ছুরিতে ২০০ টাকা লাভ হতো, সেটা এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করে দিচ্ছেন তারা।
বেড়েছে লোহা ও কয়লার দাম
ব্যবসায়ীদের দাবি, কামার পণ্যের দাম না বাড়লেও এই শিল্পের কাঁচামাল লোহা, ইস্পাত ও কয়লার দাম বছর-বছর বেড়েই চলছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর লোহার কেজিতে দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। কয়লাতে কেজি ১০ টাকা করে দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে কামারশিল্পীদের দিন মজুরিও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়লার দাম বাড়লেও গুণগত মান কমেছে। আগে খনির কয়লা পাওয়া গেলেও এখন গাছের কয়লা দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এতে কয়লার অপচয় হয় বেশি। কারণ গাছের কয়লা খুব দ্রুত পুড়ে যায়। এতে তৈরি পণ্যের গুণগত মানও কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়।
দোকানি মো. সোহাগ জানান, আগে লোহার কেজি ৪৫-৫০ টাকা ছিল, সেটা এখন ৯০ থেকে ১০০ টাকায় কিনতে হয়। আর গত কয়েক বছরে কয়লার ৫০ কেজি ওজনের বস্তার দাম বেড়েছে প্রায় ৫০০ টাকা।
একই অবস্থা চাটাই ও খাইট্টার বাজারেও
ঈদের দিন গরু জবাইয়ের পর মানুষের প্রথম যে জিনিসটি দরকার হয়, সেটি হচ্ছে চাটাই ও খাইট্টা। দা-বটি, ছুরি, চাপাতির পাশাপাশি এই জিনিসগুলোও অপরিহার্য। কিন্তু এবার এসব পণ্যের বাজারও জমে ওঠেনি। সংশ্লিষ্টরদের আশা, দ্রুতই মানুষের কোরবানির গরু কেনা শেষ হলে তাদের বিক্রিও বাড়বে।
জানা গেছে, খাইট্টা তৈরি হয় তেঁতুল গাছ থেকে। এটি বেশি আসে যশোর আর বরিশাল থেকে। তবে এবার দেশে ‘লকডাউন’ থাকায় এগুলোর পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আকার অনুযায়ী, খাইট্টার দাম ৩০০ থেকে শুরু করে এক হাজার। আর চাটাই পাওয়া যাচ্ছে ১৫০-১৮০ টাকার মধ্যে।
কারওয়ান বাজারের খাইট্টা বিক্রেতা মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, এখন বিক্রি নেই বললেই চলে। যা বিক্রি হয়, তা দিয়ে দিনে খেয়ে-দেয়ে আর কিছুই থাকে না। আশা করছি, শনিবার থেকে বিক্রি বাড়বে। তখন সবার গরু কেনাও হয়ে যাবে।
তেঁতুল গাছ দিয়ে খাইট্টা তৈরি হয় জানিয়ে বিল্লাল বলেন, এগুলো যশোর ও বরিশাল থেকে আনতে হয়। কিন্তু এবার ‘লকডাউনের’ কারণে যাতায়াত খরচ কয়েকগুণ বেশি লেগেছে। তার মধ্যে পথে-পথে চাঁদাবাজি তো ছিলোই। খাইট্টা আকারভেদে ৩০০, ৫০০, ৮০০ ও ১০০০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলেও জানান বিল্লাল।
এএইচআর/এসএসএইচ