‘বাজারের অবস্থা অনেক খারাপ। আমার আড়াই লাখ টাকায় কেনা গরু এখন দেড় লাখও বলছে না কেউ। কেনা দামের এক লাখ টাকাই নাই! গোশত হিসাব করলেও দুই লাখ টাকার বে‌শি দাম হবে। তাহলে লস দিয়ে কীভাবে বিক্রি করব।’

ঈদুল আজহার আগের দিন মঙ্গলবার (২০ জুলাই) রাতে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী গাবতলীর পশুর হাটে এভাবে নিজের উৎকণ্ঠার কথা জানান মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বাবু ক্যাটল ফার্মের কর্মী হেমায়েত। গাবতলীর হাটে এবার ৪৩টি গরু এনেছেন। বিক্রি হয়েছে মাত্র ১২টি। বাকি ৩১টি গরু বিক্রি না হওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় তিনি।

একইভাবে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে শাহজাহানপুর কোরবানির পশুর হাটে গরু নিয়ে আসা তোতা মিয়ারও। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় এ গরু ব্যবসায়ীর। ব‌লেন, ‘জামালপুরের ইসলামপুর থেকে ২৩ টি গরু নিয়ে এসেছিলাম। ১৭টি বিক্রি হয়েছে। এখনও ছয়টি আছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজার ঠিক ছিল। রাতে বৃষ্টির পর ক্রেতা কমে যায়। এরপরই বাজার কম‌তে থাকে। আজ সকাল থে‌কে  বাজার একেবারেই ডাউন।’

‌তি‌নি আরও বলেন, ‘একটি গরু কেনাসহ সবমিলিয়ে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গতকাল গরুর দাম দেড় লাখ টাকা বলেছে, দিইনি। আজ দাম বলছে এক লাখ টাকারও কম। এখন যে দাম বলছে, এ দামে বিক্রি করলে ৫০-৬০ হাজার টাকা লোকসান হবে। কিন্তু গরুর শরীরে সাড়ে ছয় মণ গোশত হবে।  গোশতের হিসাবেও তো দেড় লাখ টাকার বেশি দাম হওয়া উচিত।’ 

সন্ধ্যার দিকে শাহজাহানপুর কলোনি হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, হাটে গরু আছে। ক্রেতাও আছেন, ঘুরে ঘুরে গরু পছন্দ করছেন। কেউবা পছন্দের গরু কেনার জন্য দর কষাকষি করছেন। হা‌টের বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা আসল দামও বলছেন না। এবার অনেক টাকা লস হয়ে যাবে। অন্যদিকে, বাজেটের মধ্যে পছন্দের গরু কিনে খুশি ক্রেতারা। তারা বলছেন, বাজারে দাম স্বাভাবিক রয়েছে।

শাহজাহানপুর কলোনি হাটে আসা যশোরের গরু ব্যবসায়ী সোলেমান বলেন, ‘গতকালের চেয়ে আজ প্রত্যেক গরুতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা কম বলছে। নয়টা গরু এনেছিলাম, সাতটা বিক্রি হয়েছে। এখন দুটি আছে। দুটিই বড় সাইজের। এক একটার দাম ৯০ হাজার, এক লাখ টাকা বলছে। গতকাল যা এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। বাজারে গরু আছে কিন্তু ক্রেতা তুলনামূলক কম। যারা আছেন, তারাও কম দাম বল‌ছেন।’ 

হাটে পছন্দের গরু কেনার জন্য ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন হাসিবুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোরবানি দেওয়ার জন্য গরু কিনতে এসেছি। পছন্দ অনুযায়ী একটা কিনে নেব। দাম মোটামুটি কমই মনে হচ্ছে।

এখান থেকে পছন্দের গরু কিনতে পেরে খুশি আব্দুল জব্বার। বলেন, বাজেট ছিল এক লাখ টাকা। তবে, গরুর হাসিল নিয়ে এক লাখ তিন হাজার টাকা পড়েছে। গরু পছন্দ হয়েছে। তাই বা‌জে‌টের চে‌য়ে একটু বে‌শি দি‌য়ে কি‌নে‌ছি। আজ বাজারে গরুর দাম মোটামুটি কম।

এদিকে, শাজাহানপুরের হাসিল ঘরের দায়িত্বে থাকা নাঈম জানান, গরু যেমন আছে, ক্রেতাও আছে। সমান সমান বলা যায়। বিক্রিও হচ্ছে, তবে দাম কম। আমাদের এ কাউন্টারে ঘণ্টায় ৫০টির মতো গরুর হাসিল হচ্ছে। ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে।

গাবতলীর হাটেও কমেছে পশুর দাম

রাত ১০টার পর রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী গাবতলীর পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেছেন হাটে তোলা পশুর মালিক, ব্যবসায়ী ও কর্মীরা। তাদের উৎকণ্ঠার কারণ, সন্ধ্যার পর থেকে পশুর দাম কম বলছেন ক্রেতারা। যে গরুর দাম অন্তত চার লাখ টাকা ওঠার কথা, সেটি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা চাওয়া হচ্ছে। হঠাৎ করে দাম পড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় তারা।

মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বাবু ক্যাটল ফার্মের কর্মী হেমায়েত ঢাকা পোস্টকে বলেন, দাম পানির মতো হয়ে গেছে। যে গরুর দাম আগে ক্রেতারা সাড়ে তিন লাখ বলতেন, এখন সেটি বলছেন আড়াই লাখ। মালিক ৫০ হাজার টাকা কমিয়ে তিন লাখ চাইছেন। তাতেও আগ্রহ নেই কারও। এখানে আনা ৪৩টি গরুর মধ্যে ১২টি বিক্রি হয়েছে। বাকিগুলো বিক্রি না হলে আজই খামারে নিয়ে যাব।

নিজের পোষা গরু নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন সিরাজ সরদার। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার গরুতে সাড়ে তিন মণ গোশত হবে। যার দাম ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু তারা (ক্রেতারা) ৫০ হাজারের বেশি বলছে না। অথচ আগের দিন এমন গুরু ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

হাটে আসা ক্রেতারাও স্বীকার করছেন, আজ পশুর দাম কম। আকার অনুযায়ী গরুপ্রতি অন্তত ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা কমেছে। কম দামে কাঙ্ক্ষিত পশু পেয়ে খুশি ক্রেতারা। অন্যদিকে, শেষ রাত হওয়ায় বিপাকে পড়ে কম দামে পশু ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা।

পুরান ঢাকা থেকে এখানে কোরবানির গরু কিনতে এসেছেন ফয়সাল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, প্রতি কোরবানিতে এখান থেকে গরু কিনি। হাটে গরুর সংখ্যা বেশি। করোনার কারণে তুলনামূলকভাবে ক্রেতা কম। শেষ সময়ে এসে এক লাখ ৮৫ হাজার টাকায় গরুটি কিনতে পেরেছি। দুদিন আগে এটি কিনতে হলে অন্তত আড়াই লাখ টাকা গুনতে হতো।

একই সুরে কথা বলেন হেমায়েতপুর থেকে আসা ক্রেতা শোভন। তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বিশাল আকারের গরু কিনে মুখে তৃপ্তির হাসি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গরুর মালিক চার লাখ টাকার নিচে দিতে রাজি হননি। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম। শেষ সময়ে এসে তিনি দিতে রাজি হলেন।

এসআই/এমএইচএন/আরএইচ