ঈদ কি আনন্দের?
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদের নামাজ, কোলাকুলি, পশু কোরবানি, গোশত পাড়া-প্রতিবেশী আর স্বজনদের মাঝে বণ্টন; পরিবারে পরিবারে দেখা-সাক্ষাৎ, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া; আর দিনশেষে দীর্ঘদিনের গল্প আর না বলা কথার ডালি নিয়ে পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা। দীর্ঘদিন এটা দেখে আসছি আমরা। কিন্তু এবারের ঈদ যেন ভিন্ন... ঘরবন্দিময় ঈদ।
এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকায় ঈদুল আজহায় থেকে যাওয়া মাসুদুল আলম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার তিনি। ঈদের পরদিনই ফিরতে হবে— সরকারি এমন নির্দেশনায় বাড়ি যাননি তিনি। ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবী নাকাল। অদৃশ্য এ ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক দূরত্বের নামে হারিয়ে যেতে বসেছে হৃদ্যতা, ভালবাসা।
বিজ্ঞাপন
গাজীপুর জেলখানার ডেপুটি জেলার; ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি বলে মন খারাপ। নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই বছর আগেও এমনটি ছিল না। এ যেন অন্য রকম এক ঈদ! যা আগে কখনও দেখা যায়নি। মাস্ক পরে দূরত্ব রেখে চলাচল, ঘরবন্দি থেকে ঈদ উদযাপন; কীভাবে সম্ভব?
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে বছর দেড়েক আগে। সোয়া বছর হলো, এটি তার প্রভাব বিস্তার করেছে। এর মধ্যে পার হয়েছে তিনটি ঈদ। করোনাকালের এবার চতুর্থ ঈদ, ঈদুল আজহা। এমন এক ঈদ, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যাত্রা। পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের কারও না কারও হাসপাতালে ভর্তি থাকা কিংবা মৃত্যুর খবর। এমনও হয়েছে, আজ ঈদ কিন্তু আগের দিন রাতেই মায়ের লাশবাহী গাড়িতে সন্তান। হাসপাতাল থেকে ছুটতে হয়েছে বাড়িতে, জানাজা শেষে মায়ের শেষ যাত্রা।
বিজ্ঞাপন
ঈদ কি আনন্দের? করোনায় জীবন যাওয়া পরিবারগুলো সেটা যেন ভুলে যেতে বসেছেন। সেই সঙ্গে করোনা কিংবা ডেঙ্গুতে ভোগার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিরানন্দের সময়টাকে যেন আরও দীর্ঘ করছে।
এমন অবস্থায় আনমনে প্রশ্ন জাগে, করোনার আগে ঈদ কেমন ছিল? জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করা মেহেদি হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার আগের ঈদ ঈদের মতোই আনন্দময় ছিল। সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না, ছিল না মুখে মাস্ক। কোরবানির পশু কেনা, হাটে-বাজারে ঘোরা, ছুটোছুটি কি-না করিনি! এক কথায় ঈদের ছুটির সময়টা ছিল প্রবল উৎসাহ, আনন্দ আর উত্তেজনার। তখন তো করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছিল না। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলেই হতো কোলাকুলি, কুশল বিনিময়। চলত আড্ডা। পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া তো ছিলই। এবার বাড়িই যেতে পারিনি। ঈদটাও তাই ঘরবন্দি।
যেকোনো ঈদেই রাজধানী এক রকম শূন্য হয়ে যায়। নাড়ির টানে অধিকাংশ মানুষই ঈদ করতে ছুটে যান গ্রামের বাড়িতে। এবারও অর্ধকোটি মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। ২৩ জুলাই থেকে পুনরায় লকডাউন ঘোষণায় অনেকেই রয়ে গেছেন ঢাকায়। যে কারণে অন্যান্য ঈদের মতো ফাঁকা নেই রাজধানী। হাঁটে-বাজারে মানুষ, আর সড়কে দেখা মিলছে প্রচুর যানবাহন।
রাজধানীর তেজগাঁও বিজয় সরণি মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য আকরাম বলেন, তিন বছর ধরে ঢাকার কাজ করছি। ঈদে সাধারণত রাস্তায় যানবাহন কম থাকে। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ডিউটি করলেও বেগ পেতে হতো না। সিগন্যাল দাঁড়াত না। কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। সড়কে যানবাহন অনেক। দুপুর পর্যন্ত গাড়ি কম ছিল। বিকেলের পর গাড়ির চাপ দেখে বোঝার উপায় নেই আজ ঈদের দিন।
বিনোদন কেন্দ্রে নেই বিনোদন
ঈদের সময় উপচে পড়া ভিড় থাকে রাজধানীর চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, হাতিরঝিল, লালবাগ কেল্লাসহ বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে। কিন্তু এবার অতিমারির কারণে বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ। তাই সেখানে বিনোদনও নেই! এবার সেখানে বিগত বছরগুলোর ন্যায় দেখা যাবে না শিশুদের কোলাহল, আর স্বজনদের ঘামে মাখা আনন্দময় মুখ।
জানতে চাইলে মিরপুর চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু চিড়িয়াখানা নয়, দেশের সব বিনোদন কেন্দ্রই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখেছে সরকার। চিড়িয়াখানা খোলা থাকলে শিশুরা আসত, তাদের সঙ্গে আসত পরিবার-পরিজন। কিন্তু করোনার কারণে সব বন্ধ। আমরা এখন বসে বসে করোনার বিদায়ের দিন গুনছি। আশায় আছি ফের মুখরিত হবে চিড়িয়াখানার প্রাঙ্গণ।
এবারের ঈদেও বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আইজিপি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, মহাদুর্যোগের মধ্যেই আরেকবার ঈদুল আজহা উপস্থিত আমাদের মাঝে। এ মুহূর্তে আনন্দ অনেকটাই ম্লান। অনুরোধ রইল সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, সব সময় মাস্ক পরিধান করবেন। বিনা প্রয়োজনে ঘরে বাইরে যাবেন না। বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই অতিমারির স্বাস্থ্যবিধিগুলো আমরা মেনে চলব। সরকার সময় সময় যে নির্দেশনা জারি করছে তা মেনে চলব।
অন্যদিকে, গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, গত দেড় বছর ধরে ধারাবাহিক অভিযান ও চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষকে মাস্ক পরানোর বিষয়ে সচেতন করা যায়নি। পুলিশ গিয়ে গিয়ে মাস্ক পরাচ্ছে, পুলিশ যেই চলে আসছে মাস্কও খুলে ফেলছে। কী করবেন? যাদের পরিবারের কেউ মারা যাচ্ছেন শুধুমাত্র তারাই সচেতন হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, যে পরিবারে একজন মারা গেছেন, তারাই কেবল সচেতন হচ্ছেন, বাকিদের দেখছি না। গরুর হাটে গিয়ে দেখেন, লাখ লাখ মানুষ, কারও মুখে মাস্ক নাই। কতজনকে সচেতন করবেন, মানুষ নিজেরা সচেতন না হলে! নিজেকে রক্ষা করার বোধটা না জন্মালে কী করা যাবে?
জেইউ/এমএআর/