প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ জয়েরই অবদান। আমি ও আমার বন্ধু বেবী মওদুদ জয়ের কাছ থেকেই কম্পিউটার শিখলাম। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়লাম সেটা জয়েরই চিন্তা। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’

মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি। 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ইয়াহিয়া খান ঢাকায়, কিন্তু সারাদেশ পাকিস্তানি পতাকা কেউ ওড়ায়নি। সব বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। ৩২ নম্বর বাড়িতেও আমার বাবা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন। যদিও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ছিল। কিন্তু তাকে সবাই অস্বীকার করেছিল।’

তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারপরেই আমাদের বাসাটা আক্রমণ করে এবং তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এই আক্রমণের কিছু মুহূর্ত পূর্বে আমি, আমার ছোট বোন রেহানা এবং আমার একজন খালাতো বোন ছিল জেলি, তাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেন। আমার বাবা একরকম জোর করেই আমাদের পাঠিয়ে দেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ভাই কামাল আগেই চলে গিয়েছিল ব্যারিকেড দিতে। জামাল আর রাসেল মাকে ছেড়ে যাবে না। মার সঙ্গে থেকে যায়। আমাদের বাসা আক্রমণ করে আমার বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।’ 

তিনি বলেন, ‘যখন আবার সন্তান প্রসবের সময় হয় তখন আমাকে হাসপাতালে যেতে দিয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারি। কিন্তু আমার মাকে যেতে দেয়নি। আসলে জয়ের জন্মটা মেডিকেল কলেজেই হয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‌‘যখন সত্তরের নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশের অনেক দল অনেক নেতা আপত্তি জানিয়েছে অনেক কথা বলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন আগে নির্বাচন হোক। জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দিক। কে তাদের কে নেতৃত্ব দেবে সেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন। তাই মার্শাল ল’র মধ্যেও যেসব শর্ত ছিল সেসব শর্ত মেনেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গোটা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারি ডিক্টেকর কখনো এটা ভাবতে পারে নাই আওয়ামী লীগ এত শক্তিশালী সংগঠন যে তারা গোটা পাকিস্তানের শাসন ভার নিতে পারে। তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা আমাদের ওপরে গণহত্যা শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, বন্দী করে রাখে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭১ সালে জয় যখন জন্মগ্রহণ করে জয়ের নামটা আমার আব্বার দেওয়া। তাই আমরা জয় রেখেছিলাম। যেহেতু বন্দীখানার মধ্যে আমাদের জন্য তো আনন্দের কিছু ছিল না। আমার মা বললেন, জয় আসার পরে অন্তত একটা কাজ পেলাম। আমরা যেন একটু সজীব হলাম। সেই জন্য সজীব নামটা কিন্তু আমার মায়ের দেওয়া। সেই নামটা আমার মা দিয়েছিলেন।’

সজীব ওয়াজেদ জয়ের শিক্ষা জীবনের বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সে চান্স পায় এমআইটিতে। এমআইটিতে যখন ভর্তি হয় তখন আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাই। তাকে যে সহযোগিতা করব, সেই সহযোগিতা আমি করতে পারিনি। আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যার জন্য সে একটা সেমিস্টারের টাকা দিতে পারেনি। দেশের প্রধানমন্ত্রীর থাকা সত্ত্বেও আমার ছেলে তার সেমিস্টারের টাকা দিতে পারেনি বলে এমআইটি থেকে তার নাম কেটে যায় এবং সে চলে আসে ঢাকায়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আবার আমরা পাঠাই। সেখানে সে চাকরি নেয় আমেরিকায়। সেখানে সে চাকরি করতে থাকে। আমি ২০০৭ সালে যখন যাই আমেরিকায় তখন আমার অনুরোধে, কারণ আমার মনের মধ্যে একটা দুঃখ ছিল যে আমার ছেলেটা পড়তে চেয়ে পড়তে পারল না। সেজন্য আমি তাকে অনুরোধ করি যে তুমি হার্ভার্ডে একটা দরখাস্ত কর, যাতে তুমি ভর্তি হতে পার।’

তিনি বলেন, ‘সারাদিন চাকরি করে আসে তারপরে অ্যাপ্লিকেশন করা। তো আমি অনেক জোর করি। তারপর সে অ্যাপ্লিকেশনটা করে। করার পরে পারমিশন হয়ে যায়। তখন আমি কারাগারে বন্দী। আমি অ্যারেস্ট হয়ে যাই যখন, তখনই শুনলাম জয়ের পারমিশন হয়ে গেছে সে ভর্তি হবে। তো আমি শুধু একটা খবর দিয়েছিলাম, যে তুমি বন্ধ করো না। তুমি হার্ভার্ডে ভর্তি হও, যেভাবে পার পড়। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারপর সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেখানে যায়। মাস্টার ডিগ্রি নেয়। সেটা ছিল পাবলিক সার্ভিস ও পলিটিক্সের ওপরেই। এভাবে পড়াশোনা সবসময় ভেঙে ভেঙে করলেও নিজের চেষ্টায় করেছে। খুব বেশি আমাকে বেগ পেতে হয়নি। তার পড়াশোনা যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ছিল বলেই সে করতে পেরেছে।’

সরকার প্রধান বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ জয়েরই অবদান। তারই চিন্তা ভাবনা, তারই বক্তব্য। আমি কম্পিউটার শিখেছি জয়ের কাছ থেকে। স্কুল থেকে যখন কম্পিউটার নিয়ে আসতো আমাকে প্রোগ্রাম করে দিত, আমি বসে বসে সেটা করতাম। আমি আর আমার বন্ধু বেবী মওদুদ জয়ের কাছ থেকে কম্পিউটার চালানো শিখেছি দুজনে মিলে। আমাদের হোমওয়ার্ক দিত আমরা করতাম।’  

তিনি বলেন, ‘আজকে যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করলাম সেটা তারই চিন্তাভাবনা। সেই আমাকে সবসময় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে কী কী করতে হবে সবই কিন্তু জয়ের কাছ থেকে আমাদের শেখা। এইটা হলো বাস্তবতা। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশটাকে যদি ডিজিটালাইজড না করা হতো এই করোনা মোকাবিলা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যেত। আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না। মানুষের জীবন-জীবিকা চালানো, মানুষের হাতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া, মানুষের কাছে যে আমরা সাহায্যের টাকা পৌঁছাচ্ছি এসবই কিন্তু আমরা এই ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে করে যাচ্ছি। আজকে যোগাযোগ, অর্থনীতি সচল রাখা সব কিছু সহজ হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছিল বলে। সেটা আমরা সময়মত করতে পেরেছিলাম সে কারণে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুই ধরনের রাজনীতি আছে। কেউ রাজনীতি করে অর্থ-সম্পদ বানিয়ে ভোগবিলাস করতে চায়। আর কেউ রাজনীতির মধ্য দিয়ে জনগণের সেবা করতে চায়, কল্যাণ করতে চায়, মঙ্গল করতে চায়। জাতির পিতা আমাদেরকে সেই আদর্শ শিখিয়েছেন। তিনি কিন্তু নিজের জীবনের জন্য কিচ্ছু করেননি। কখনো চিন্তাও করেননি। তিনি কিন্তু কখনও ভাবেননি। এমনকি আমরা ছেলেমেয়ে, আমাদের কী হবে, সেটাও তিনি কোনোদিন বলেননি-ভাবেননি। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে চিন্তা করতেন। চিন্তা করেননি বাবা হিসেবে, তা না। কিন্তু শুধু আমাদের জন্য কিছু করবেন, সেই চিন্তা তার ছিল না। তার চিন্তা ছিল সার্বিক।’ 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ একেবারে গ্রামে পড়ে থাকা যে মানুষটা তার জীবনটাকে সুন্দর করা, তার ভাগ্যটা পরিবর্তন করা, তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়া.... অর্থাৎ মানুষের যে মৌলিক চাহিদাগুলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; সেটা শুধু শহরের মানুষ না, একেবারে গ্রামের তৃণমূলে যে মানুষগুলো পড়ে আছে তাদের জীবনটা পরিবর্তন করা। এটাই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন এবং এটাই ছিল তার আদর্শ। সেই চেতনা নিয়েই এই দেশকে তিনি স্বাধীন করেছিলেন।’ 

তিনি বলেন, ‘আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এই দেশের মানুষ প্রথম এটা অনুভব করেছে। সরকার জনগণের সেবক যেটা জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরাও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলি। আমরা জনগণের জন্য কাজ করব, জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করব। জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করব।’

গ্রামের মানুষের ধারণা করোনা হলে সে অচ্ছুত হয়ে যাবে

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একেবারে গ্রাম পর্যায়ে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। সেখানে সবাই শুধু রেজিস্ট্রেশন করতে হবে তা না। আইডি কার্ড দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সরাসরি টিকা নিতে পারবে। সেই জন্য স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের মানুষকে সহযোগিতা করার আহ্বান করছি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে একটা ভয় ও আতঙ্ক ছিল যে টিকা নিলে কী হবে? অনেক কিছু হয়ে যাবে। নানা রকমের একটি ভীতি ছিলো। এখন সবাই আস্তে আস্তে সেই ভীতি কাটাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সমস্যা এখনও রয়েছে। যেটা আমি গ্রাম থেকে খবর পাই। কেউ করোনা টেস্ট করতে চায় না। তাদের ধারণা টেস্ট করলে করোনা আছে শুনলে সে অচ্ছুত হয়ে যাবে, তার সাথে মানুষ মিশবে না। এই ভয় করে। কিন্তু এটাতো ঠিক না।

তিনি বলেন, ‘টেস্ট করলে তার যে চিকিৎসা হবে, সে অন্যকে সংক্রমিত করবে না। নিজে বাঁচবে এবং অন্যকে বাঁচাবে এই ধারণাটা মানুষের মধ্যে দিতে হবে। এটা আমাদের সকল নেতাকর্মী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। তাছাড়া টিকা দিয়ে দিতে পারি, তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই। সেক্ষেত্রে করোনা হলেও বেশি ক্ষতি হচ্ছে না।’ 

সরকার প্রধান বলেন, করোনাভাইরাসের জন্য সকলের সুরক্ষিত থাকা দরকার। ইতোমধ্যে টিকা যেখানে যা পাওয়া যাচ্ছে তা আমরা কিনছি। তার জন্য টাকাও রাখা আছে। প্রয়োজনে আরও টাকা খরচ করব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক যারা টিকা নিতে পারবেন, তারা সবাই যাতে টিকা নিতে পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। ইতোমধ্যে ১ কোটি ৮৭ লাখের কাছাকাছি টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা আরও টিকা দিচ্ছি।’

এইউএ/ওএফ