আইসিইউর প্রত্যাশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে করোনা রোগী আসছেন ঢাকায়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একটি, শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে দুটি, শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে একটি, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে ছয়টি এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর- পঙ্গু হাসপাতাল) তিনটি আইসিইউ শয্যা খালি আছে

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে মো. কাউসার করোনায় আক্রান্ত ভাই সোহাগকে নিয়ে মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) দুপুরে এসেছেন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র- আইসিইউতে ভর্তি করাতে। কিন্তু শয্যা (বেড) খালি না থাকায় ভাইকে নিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাকে।

ঢাকা পোস্টকে কাউসার বলেন, সোমবার এক আত্মীয়কে ফোন করে মহাখালীর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা বরাদ্দ রেখেছিলেন। কিন্তু সোহাগকে রূপগঞ্জ থেকে আনতে আনতে সেই শয্যা দখল করে নেন অন্য এক রোগী। একই দিন করোনা আক্রান্ত ভাইকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আইসিইউ না পেয়ে ফিরে যান বাড়ি। আজ আবার কুর্মিটোলায় এসেছেন কিন্তু চিত্র একই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাউসার বলেন, ভাইকে আর বাঁচাতে পারব না। একটা শয্যাও খালি পাচ্ছি না। দিনদিন অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই বলে আইসিইউ খালি নেই।

কাউসারের মতো শত শত করোনা রোগী ঢাকায় আসছেন আইসিইউ শয্যার আশায়। কিন্তু আইসিইউ তো পাচ্ছেন না সাধারণ শয্যা পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

এদিকে, অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে পারছে না রাজধানী ঢাকা। বিশেষায়িত সরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ প্রায় শেষ। ৯৬ ভাগ শয্যা রোগীতে ভর্তি। বাকিগুলো রাখা হয়েছে অন্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত করোনা রোগীর জন্য।

সরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ প্রায় শেষ। ৯৬ ভাগ শয্যা রোগীতে ভর্তি

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার ১৭টি সরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে মোট সাতটিতে আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে। বাকিগুলোতে একটি শয্যার জন্য সিরিয়ালে আছেন দু-তিনজন রোগী।

বর্তমানে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে একটি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একটি, শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে দুটি, শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে একটি, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে ছয়টি এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর- পঙ্গু হাসপাতাল) তিনটি আইসিইউ শয্যা খালি আছে। অর্থাৎ ঢাকা শহরের সরকারি করোনা হাসপাতালগুলোর মোট ৩৮৪টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি আছে মাত্র ১৬টি।

তবে নাম প্রকাশ না করে একটি হাসপাতালের পরিচালক ঢাকা পোস্টকে জানান, বেশ কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা থাকলেও সাধারণ রোগীদের স্থান সেখানে হবে না। যেমন- হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কেবলমাত্র করোনা আক্রান্ত হার্টের রোগীই শয্যা পাবেন। পঙ্গু হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ শয্যা খালি থাকলেও সেখানে কেবল করোনা আক্রান্ত পঙ্গু রোগী ভর্তি হতে পাবেন। তাই ঢাকার হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই বললেই চলে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৩৮ জন। এদিন (বুধবার) মারা যান ২৩৫ জন।  নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৮১৭ জন। মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৩ লাখ ৯ হাজার ৯১০ জন।

কারোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলছে। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।

কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে যে হারে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলছে সহসা তা কমবে না। তাদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। এভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে আইসিইউ পাওয়া তো দূরের বিষয়, কোভিডের সাধারণ শয্যাও পাওয়া যাবে না। ইতোমধ্যে এমন আশঙ্কার সত্যতাও মিলছে।

গত কয়েকদিন সরেজমিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেখানে আসছেন করোনায় আক্রান্ত রোগীরা। কেউ কেউ ভর্তি হতে পারলেও অনেকে ফিরে যাচ্ছেন, কারণ শয্যা খালি নেই। অনেকে আবার একাধিক দিন এসেও ফিরে যাচ্ছেন। অসুস্থ রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে হন্তদন্ত হয়ে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনরা।

যে কারণে আইসিইউ সংকট

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংকট কিছুটা এড়ানো গেলেও তৃতীয় ঢেউয়ে এসে তা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, করোনার বিস্তার গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জেলে ও উপজেলা শহরে করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর চাপ এসে পড়ছে বিভাগীয় এবং রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে। ফলে এসব হাসপাতালে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যায় সংকট দেখা দিয়েছে।

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইসিইউ ও সাধারণ শয্যার সংকট হবে— এটি নতুন কিছু নয়। ২০২০ সালের জুন-জুলাই থেকেই এ সংকট চলছে। অক্সিজেনের সংকটও রয়েছে। গত বছর কিছু পদক্ষেপের কারণে সংকট কম ছিল। কিন্তু এ বছর আবারও তৈরি হয়েছে। এটি মোকাবিলায় ‘রোগী ব্যবস্থাপনার’ ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি বলেন, একজন করোনা পজিটিভ রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি জোর দিতে হবে। কারণ, করোনা হলেই যে হাসপাতালে যেতে হবে— এমন নয়। তাকে মানসিকভাবে শান্ত রাখতে হবে। অস্থিরতা কমিয়ে বাসায় সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায় রেখেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং ভালো খাবারের ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে রোগী বাসায় বসেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এভাবে ২০ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।

‘যাদের অক্সিজেনের লেভেল ৮০ থেকে ৮৫ এর মধ্যে থাকবে, তাদের নিয়ে যেতে হবে অস্থায়ী করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। সেখানে তারা প্রতিদিন ২-৩ লিটার অক্সিজেন পেলে সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাদের মধ্যে যাদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে তাদের বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। তাহলে হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে এবং সবাই করোনার ভালো চিকিৎসা পাবেন।’

মারাত্মক হওয়ার আগে আতঙ্কিত হচ্ছেন অনেকে

করোনার শুরু থেকে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা বলেন, গ্রামাঞ্চলে যেসব রোগী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার আগেই জেলা বা উপজেলার হাসপাতালে ছুটছেন। কারণ, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে, জেলা বা উপজেলার হাসপাতালে ঠিকভাবে অক্সিজেন দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় চিকিৎসকরা রোগীদের বিভাগীয় বা রাজধানীর করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। এ কারণে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে। মূলত, সময় মতো প্রাথমিক চিকিৎসা ও অক্সিজেন না পাওয়ায় অনেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন রাস্তায়।

জেলা-উপজেলার চিকিৎসা-ব্যবস্থায় এখনই নজর দিতে হবে

করোনা রোগীদের চাপ বিভাগীয় ও রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো থেকে কমাতে এখনই উপজেলা ও জেলাপর্যায়ের চিকিৎসা-ব্যবস্থায় সরকারকে নজর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে যে হারে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে আর কিছুদিন পর আইসিইউ তো দূরের কথা সাধারণ শয্যাও পাওয়া যাবে না।

করোনা রোগীর স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন

তাদের মতে, গ্রামপর্যায়ে দুর্বার গতিতে ছড়াচ্ছে করোনার সংক্রমণ। দলে দলে মানুষ আক্রান্ত হয়ে উপজেলা ও জেলার হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। সেখানে ভর্তি হয়ে সাধারণ চিকিৎসা পেলেও যে-ই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে তখনই তৈরি হচ্ছে সংকট। কারণ, অধিকাংশ জেলা ও উপজেলার হাসপাতালে করোনা রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার মতো সুব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক রোগী শুধুমাত্র অক্সিজেন সেবার জন্য ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ছুটছেন। এত রোগী একসঙ্গে এক জায়গায় ছুটে আসায় তৈরি হচ্ছে সংকট।

জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে শুধুমাত্র অক্সিজেন দেওয়ার সুব্যবস্থা করে দিলে বিভাগীয় ও রাজধানীমুখী করোনা রোগীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে— মনে করেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড চিকিৎসক ও সহকারী রেজিস্ট্রার (সার্জারি) ডা. মারুফ হাসান অভি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবশ্যই করোনা চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তা না হলে রাজধানীসহ দেশের সব বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে সংকট বাড়তেই থাকবে।

তিনি বলেন, শুরু থেকেই ধারণক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমাদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা আরও ভালো করা গেলে কোনো সংকট তৈরি হতো না। সবচেয়ে বড় বিষয়, এখনও আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি উদাসীন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কোনোভাবেই করোনা যুদ্ধে আমরা জয়ী হব না।

এমএসি/এমএআর/এমএইচএস