শুধু একটাই প্রশ্ন সব সময়, কেন এই হত্যাকাণ্ড
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৫ আগস্ট আমি তো আপনজন সবাইকে হারিয়েছি। শুধু একটাই প্রশ্ন সব সময়, যে কেন এই হত্যাকাণ্ড। কী অপরাধ ছিল আমার বাবার? আমার মায়ের, আমার ভাইদের? যিনি নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করলেন, সমস্ত জীবনের সুখ শান্তি বিলিয়ে দিলেন একটা জাতির স্বাধীনতার জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তাকে সেই বাঙালিই খুন করল, হত্যা করল, কেন?
রোববার (৮ আগস্ট) ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব-এর ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন’ এবং ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব পদক-২০২১ প্রদান’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যুক্ত হন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ছয় দফা না আট দফা এটা নিয়ে যখন চরম বিতর্ক সেই ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং তো আমাদের বাসায়ও হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগেরও অনেক সিনিয়র নেতা চলে গেছেন আট দফার পক্ষে। কারণ পাকিস্তান থেকে নেতারা এসেছেন যে আট দফার পক্ষ নিয়ে। কিন্তু আট দফা ছিল একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। এটা তাদের মতো শিক্ষিত অনেকেই হয়তো ধরতে পারেননি। কিন্তু আমার মায়ের কাছে সেটা স্পষ্ট ছিল। এখানে আমার মায়ের স্পষ্ট কথা ছিল ছয় দফার একটা দাড়ি-কমা-সেমিকোলন বদলাবে না। যেটা আব্বা বলে গেছেন সেটাই হতে হবে। সেই সিদ্ধান্তটাই ওয়ার্কিং কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা : প্রধানমন্ত্রী
তিনি বলেন, সেই ৭ মার্চের ভাষণ। তার আগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হলো সেখানে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের নেতাদের যে প্রচণ্ড চাপ। আইয়ুব খান মিটিং ডেকেছে যেতেই হবে। আমার মায়ের কাছে প্যারোলে যাওয়াটা অত্যন্ত অসম্মানজনক ছিল। আইয়ুব খান যদি আলোচনা করতে চায় সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ জনগণ তখন রীতিমত আন্দোলন করছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক নেতা, বড় বড় আইনজীবী, বড় সাংবাদিকসহ অনেকেই প্যারোলে যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছিল। আমার মা কিন্তু সেখানে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদি এই সিদ্ধান্তটা সঠিকভাবে না নিতেন আর খবরটা আমার বাবার কাছে না পৌঁছাতেন, তাহলে বাংলাদেশে কোনদিনও স্বাধীন হতো না।
তিনি বলেন, এরপর এলো ৭ মার্চের ভাষণ। সেই ভাষণের সময়েও অনেকের অনেক কথা ছিল। কেউ কেউ এত উত্তেজিত হয়ে, উৎসাহিত বা উত্তেজিতই বলবো। যেটা এই মুহূর্তেই ঘোষণা দিতে হবে। তাহলে তো জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো ঘটনা ঘটে যেত। ওখান থেকে একটি মানুষও জীবিত ফিরে যেতে পারতো না। আর কোনদিন যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা যেত না।
সরকার প্রধান বলেন, সেখানে আমার মায়ের যে কথা, যে পরামর্শ। সেটাই কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করি। এরকম আরও বহু সময়ে আমি দেখেছি। সব থেকে বড় কথা হলো যে নিজের জীবনটাকে তিনি সবসময় খুব সাদাসিধে রেখেছেন।
তিনি বলেন, আমার আব্বা যখন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের মধ্যে মার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তাতে যদি বিলাসিতার হয়, তাহলে অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে। নজর খারাপ হয়ে যাবে। ওই বত্রিশ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে তিনি কখনও আসেননি। এসেছেন হয়তো ঘুরে দেখে গেছেন। কিন্তু এখানে বসবাস করার কথা কখনো চিন্তাও করেননি। আমার মাকে আমি সবসময় একই রকম দেখেছি। কখনো কোনো ব্যাপারে বেশি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না।
শেখ হাসিনা বলেন, দল চালাতে গেলে বা দলের নেতাকর্মীরা যখন জেলে তাদের পরিবারের ভরণপোষণ বা তাদের বাজারের টাকাটা পর্যন্ত আমার মা নিজে দিয়েছেন। যার জন্য নিজের গহনাগাটি বা আমাদের বাড়ির অনেক জিনিস তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনদিন বলেননি যে আমার এটা নাই বা হা হুতাশ। আমি আমার মার কাছে কখনো হা হুতাশ শুনিনি। কোনো দিন তিনি মুখ ফুটে বলতে না যে এটা নাই। বরং আমাদের বাড়িতে এটাই ছিল যে নাই বলতে পারবে না। কী লাগবে, বলো যে এটা লাগবে। নাই বলতে পারবে না। এভাবে তিনি কিন্তু একদিকে সংসার সামলিয়েছেন অপরদিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুলো। সে সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সময়ে যাতে হয় তার ব্যবস্থা করেছেন।
তিনি বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম এই দলকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ সব সময় সঠিক পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যাতে চলতে পারে সেই দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। সমস্ত তথ্যগুলো আমার বাবার কাছে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া এবং তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো এই কাজগুলোও তিনি গোপনে করেছেন। এইভাবে কিন্তু তিনি তার জীবনটাকে উৎসর্গ করেছেন, আমার বাবা যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেন সেই আদর্শের কাছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু কখনো রাজনৈতিক নেতা হতে হবে বা রাজনীতি করে কিছু পেতে হবে সেই চিন্তা কিন্তু তার ছিল না। কোনো সম্পদের প্রতিও তার কোনো আগ্রহ ছিল না। নিজের যথেষ্ট যা ছিল সেইটুকুই। এভাবেই কিন্তু তিনি নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। আর সবশেষে আপনারা দেখেছেন পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। মানুষ যখন একটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন তার মনে সব থেকে আগে আসে নিজের জীবনটাকে বাঁচানোর এবং নিজের জীবনটাকে ভিক্ষা চাওয়ার। আমার মা খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি (বঙ্গমাতা) নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। সোজা বলে দিয়েছেন। আমার আব্বাকে যখন হত্যা করলো সেটা যখন তিনি দেখলেন। তখনই তিনি খুনিদের বললেন, তোমরা ওনাকে মেরেছো আমাকেও মেরে ফেল। তারা বলেছিল, আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমাদের সঙ্গে আমি যাব না। তোমরা এখানেই আমাকে খুন করো।
তিনি বলেন, ঘাতকদের বন্দুক গর্জে উঠেছিল। আর সেখানেই আমার মাকে তারা নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমাদের পরিবারে তো কেউ ছিল না বেঁচে। আমরা দুই বোন বিদেশে ছিলাম। কতটা সাহস একটা মানুষের মনে থাকলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি জীবন ভিক্ষা না নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের অবহেলিত নারী সমাজ একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে। আমি মনে করি আমার মায়ের জীবনের এই কাহিনী শুনলে অনেকেই হয়তো অনুপ্রেরণা পাবে। শক্তি, সাহস পাবে। দেশের জন্য, জাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করবে।
এইউএ/এসএম