যে পথ কেউ চেনে না সেই পথে হাঁটেন পলাশ
জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড়দের সাথে কাজ করছেন পলাশের প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশন’
একদিকে মাঠ সামলাচ্ছেন, অন্যদিকে ক্লাস! না, ক্লাসের ফাঁকে ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে ব্যস্ততার কথা বোঝানো হচ্ছে না। বলা হচ্ছে একজন স্পোর্টস এজেন্টের কথা, যিনি খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন এক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘স্বপ্নহীন’ অসংখ্য তরুণ নিজেদের নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। অনেককে আলো খুঁজে দেওয়া এই শিক্ষা-উদ্যোক্তার নাম মো. পলাশ হোসাইন। তিনি পলাশ সকাল নামেই বেশি পরিচিত।
পলাশ পড়াশোনা করেছেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। তবে হেঁটেছেন অন্য রাস্তায়। নিজেকে গড়ে তুলেছেন স্পোর্টস এজেন্ট এবং উদ্যোক্তা হিসেবে। গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশনস এবং হাউজ অব এনইউবিডইয়ানস। ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে নিজের স্বপ্ন পূরণে এসে পড়েছেন অন্য ভুবনে! নতুন ভুবনে অনেকবার ‘না’ শুনলেও অপেক্ষায় ছিলেন ‘হ্যাঁ’ শব্দটা শোনার। তার লক্ষ্যের মতো গল্পটাও ব্যতিক্রম!
বিজ্ঞাপন
একের পর এক অধ্যায় পাল্টানোর গল্প
কুমিল্লা শহরে বেড়ে ওঠা পলাশের পড়ালেখার বিষয় ছিল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০১২ সালে গাজীপুরের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট) থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। স্নাতক পরবর্তী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজের কর্মজীবন শুরু করলেও এই চার দেয়ালের অফিসে যেনো আঁকড়ে ধরতে পারেনি পলাশের মন।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলায় পলাশের মন ছিল ক্রিকেটের বাউন্ডারি লাইনে। পড়ালেখার মারপ্যাঁচে সম্ভব হয়নি ক্রিকেটার পলাশ তৈরির গল্প। তবে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পূরণের সময় কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। বাসা থেকে অফিস এবং অফিস থেকে বাসা এই রুটিনে মন না বসাতে পেরে ভেবে বসেন সব ছেড়ে ক্রিকেটের সাথে নতুন গল্প তৈরি করবেন। এরইমাঝে চিন্তা আসে কীভাবে একজন খেলোয়াড় মাঠের পাশাপাশি নানান ব্যবসায়িক দিক সামলান! এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই খুঁজে পান দেশের গণ্ডিতে নতুন শব্দ স্পোর্টস এজেন্ট। সাতপাঁচ না ভেবেই বুঁদ হয়ে পড়েন এই পেশার অলিগলিতে। ঠিক করে বসলেন এই শব্দেই গড়ে তুলবেন নিজের নতুন আরেক অধ্যায়। পলাশের নতুন অধ্যায়ের গল্পের শুরুটা এখান থেকেই।
ক্রিকেটারদের নিয়ে পথচলা শুরু
নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন ক্রিকেটারকে। নতুন এই শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে এই ক্রিকেটারের মনেও যেনো খটকা লাগল। স্বাভাবিকভাবেই পলাশের প্রস্তাবে না করেননি তিনি। উৎসাহ দেন নতুন এক পথচলায়। পলাশও সাহস করে ছেড়ে দেন নিজের চাকরি। গড়ে তুলেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশন’। প্রায় প্রতিটি ক্রিকেটারের কাছে উপস্থাপন করেন এই উদ্যোগ। তবে প্রথম দিকে দ্বিধায় ছিলেন তারাও। “হ্যাঁ” বলে বসেন অনেকেই। ব্যাস! পলাশকে আর ঠেকায় কে! শুরু করেন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
শুরুর দিকে পলাশের সাথে যুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা কম হলেও ব্যাপারটা এখন পুরোই উল্টো। বর্তমানে জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড়দের সাথে কাজ করছেন পলাশের প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার প্লে কমিউনিকেশন’। মূলত খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের যোগা-যোগস্থাপনের কাজটাই পরিচালনা করে তারা। সহজ করে বললে, কাজটা ‘ব্র্যান্ড ব্যবস্থাপকের’ মতো। প্রথম অবস্থায় নিজেই সব পরিচালনা করলেও বর্তমানে নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থানও।
শিক্ষার্থীদের জন্য পলাশের নতুন ভুবন
ক্রিকেট নয়, পড়াশোনায়ও মন দিয়েছেন পলাশ সকাল! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘হাউজ অব এনইউবিডিয়ানস’। এর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বৃহদাকার একটি অংশজুড়ে কাজ করার মতো কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। শিক্ষার্থীদের আত্মোন্নয়ন, মানসিক কাঠামো পরিবর্তন ও দক্ষতা বৃদ্ধিসহ নানা সফলতা নিয়ে এক বছর পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
নিয়মিত অনলাইন ক্লাস অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই প্লাটফর্মের ফেসবুক পেজে। প্রতি রবিবার ও বুধবার রয়েছে চাকরির প্রস্তুতির ক্লাসও! যেখানে অনলাইনেই যুক্ত হচ্ছেন দেশের নানান স্থানের শিক্ষার্থীরা। সাথে মাসে দুইবার পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় বলে জানিয়েছেন প্লাটফর্মটির সদস্যরা। ক্লাস নিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইউনিটের সম্মানিত সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদসহ দেশের স্বনামধন্য পরিচিত শিক্ষকরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম ও একমাত্র প্ল্যাটফর্ম ‘হাউজ অব এনইউবিডিয়ানস’ প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দারুণ সাড়া জাগায়। এখন পর্যন্ত এই প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। গঠিত হয়েছে ১৫টি ক্যাম্পাস দল এবং দুটি জাতীয় প্রতিযোগিতা। এই এক বছরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২৫টি ক্লাস, যেগুলো এখন পর্যন্ত দেখা হয়েছে ৫৫ লাখের বেশি বার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ের কথা মাথায় রেখে আয়োজিত হয়েছে ১১টি ট্রেনিং সেশন।
বর্তমানে ক্লাস ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে চলছে হাউজ অব এনইউবিডিয়ানসের কার্যক্রম। সে তালিকায় আছে চাকরি সম্পর্কিত ক্লাস, চাকরি খুঁজে পেতে সাহায্য করা থেকে শুরু আত্ন-উন্নয়ন বিষয়ক সেশন, সফল ব্যক্তিত্বের গল্পও। শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুইজ ও পরীক্ষা।
অর্জনের ঝুলি দেখার মতো, স্বপ্ন আরও বড়
২৮ বছর বয়সী এই তরুণের অর্জনের ঝুলিও বেশ বড়। ক্যাম্পাসে তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। ২০১০ সালে হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ইন্টার ইউনিভার্সিটি ইংলিশ ডিবেটে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত ‘টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট-২০১২’তে পেয়েছেন ১ম রানার আপের পুরস্কার। এছাড়াও নিজের মেধার পরিচয় অংশীদার হয়েছেন আরো অনেক অর্জনের। সমানতালে আলো ছড়িয়েছেন ক্যাম্পাসেও। হোক সেটা স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়- সবকিছুর পাশাপাশি বুঁদ ছিলেন বইয়ের ভুবনেও। সম্প্রতি গ্লোবাল ইয়ুথ পার্লামেন্ট নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল ক্রিয়েটিভ লিডার’ বিভাগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
এমটি/এইচকে