সন্তানদের সঙ্গে প্রকৌশলী রাজীব বিন ইসলাম

১৪ বছর আগে আফগান ওয়্যারলেস কোম্পানিতে চাকরি নেন বাংলাদেশি প্রকৌশলী রাজীব বিন ইসলাম। সবশেষ তিনি আফগান ওয়্যারলেসের পিবিএক্স ও কন্টাক্ট সেন্টার পরিচালন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওয়্যারলেসের কাবুলের প্রধান দফতরেই কাজ করতেন রাজীব। মাসখানেক আগে ছুটি কাটিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাবুলে ফিরে যান তিনি। সম্প্রতি তালেবান কাবুল দখল করার পর নিরাপত্তা ইস্যুতে দেশে ফিরে আসেন রাজীবসহ ছয় বাংলাদেশি। বাংলাদেশে রাজীবের বাড়ি গাজীপুরে।

বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ, এ অবস্থায় বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের দেশে ফেরাটা মোটেই সুখকর ছিল না। নানা পথ পাড়ি দিয়ে ফিরেছেন স্বদেশে। দুই দফায় ফ্লাইট বাতিল, কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলা, দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা, কাবুলের চেকপোস্টে তালেবানের মুখোমুখি হওয়া, মার্কিনিদের বিশেষ ফ্লাইটে চড়ার অনুমতি, কাবুল টু দোহা ও দোহা টু ঢাকা ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন প্রকৌশলী রাজীব। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক নজরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : আফগানিস্তানে কবে গিয়েছিলেন? আফগান ওয়্যারলেস কোম্পানিতে কত বছর কাজ করেছেন?

রাজীব বিন ইসলাম : ২০০৭ সালে আমি আফগান ওয়্যারলেসে চাকরির খবর পেয়েছিলাম। ওই বছরের নভেম্বরে চাকরিটা পেয়ে আফগানিস্তানে পৌঁছাই। মূলত প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন-আফগান যৌথ মালিকানার। শুরু থেকে আফগান ওয়্যারলেসের কাবুলের প্রধান দফতরেই আমি কাজ করেছি। সর্বশেষ আফগান ওয়্যারলেসের পিবিএক্স ও কন্টাক্ট সেন্টার পরিচালন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘ ১৪ বছর আপনি আফগানিস্তানে অবস্থান করেছেন। আফগানিস্তানের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। খুব কাছ থেকে দেশটিকে কেমন দেখেছেন?

রাজীব বিন ইসলাম : ২০০৭ সালে সেখানে পৌঁছানোর পর আমি কাবুলের জনজীবন স্বাভাবিক দেখেছি। সেখানকার পরিবেশ ভালো ছিল বলেই আমরা এত দীর্ঘ সময় কাজ করতে পেরেছি। শহরের পরিস্থিতি সবসময় স্বাভাবিক ছিল। আমাদের কোম্পানির কার্যক্রমও ঠিক ছিল। তবে আমাদের বাইরে যাওয়ার আগে কোম্পানি থেকে অনুমতি নিতে হতো। তালেবানের পাশাপাশি আফগানিস্তানের অন্য জঙ্গিগোষ্ঠী বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ওপর হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তার নির্দেশনা মেনেই চলতে হতো।

ঢাকা পোস্ট : তালেবান কাবুল দখলে নেওয়ার পর আপনি সেই শহরেই অবস্থান করছিলেন। সে সময়টাতে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন ছিলেন?

রাজীব বিন ইসলাম : সবাই একটু উদ্বেগের মধ্যে ছিল। সবাই ভাবছিল কী না কী হবে। আমরাও উদ্বিগ্ন ছিলাম। এরকম পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেহেতু হঠাৎ একটা পরিবর্তন, সবার মধ্যে উদ্বেগ ছিল। তালেবান কাবুল দখলের পর শুরুর দিকটায় একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। প্রথম এক-দুই দিন ওই পরিস্থিতিতে আমরা একটু বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম, চিন্তিত ছিলাম।

ঢাকা পোস্ট : তালেবান কাবুল দখলের পরের দিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট আপনাদের দেশে ফেরার ফ্লাইট ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগাম কোনো বার্তা ছিল কি না? 

রাজীব বিন ইসলাম : আমি দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে কাবুল গিয়েছি মাত্র মাস খানেক হয়েছে। জুলাইয়ের ৯ তারিখে আফগানিস্তানে যাই আমি। ১৬ আগস্ট আবার দেশে ফেরার চেষ্টা করতে হলো। আমার ছুটির সময়ও হয়নি। আরও এক মাস পরে হতো। আগস্টের শুরুতে মার্কিন সহকর্মীদের মাধ্যমে একটি বার্তা পাই। কাবুলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস মার্কিন নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব আফগানিস্তান ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ ৩১ আগস্ট মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি নিজেদের গুটিয়ে নেবে। আফগান ওয়্যারলেসের মার্কিন সহকর্মীদের মতো আমরাও দ্রুত কাবুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা বলতে সহকর্মী মো. কামরুজ্জামান, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ইমরান হোসাইন, আবু জাফর মো. মাসুদ করিম ও শেখ ফরিদ উদ্দিন। তারাও প্রকৌশলী হিসেবে ওয়্যারলেসে বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান ১৪ জন বিদেশি বিশেষজ্ঞের সবাইকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আফগান ওয়্যারলেস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- বিদেশিরা দেশে ফিরে অনলাইনে কাজে যুক্ত থাকবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আফগানিস্তানে গিয়ে আবার কাজে যোগ দেবে। সেভাবেই ১৬ আগস্ট দেশে ফেরার টিকিটও কাটা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের আর ফেরা হয়নি। তবে আমরা যদি চাইতাম সেখানে থেকে যাব, কোম্পানিতে থাকা যেত। আমাদের তো ভ্রমণ করা লাগত না। কিন্তু থেকে গেলে বাণিজ্যিক ফ্লাইট খোলা ছাড়া দেশে ফেরা যেত না।

ঢাকা পোস্ট : আপনাদের প্রথম ফ্লাইট বাতিল হওয়ার পর প্রায় ১১ দিন আফগানিস্তানে থাকতে হয়েছে। তখন সেখানকার পরিস্থিতি কেমন দেখেছিলেন?

রাজীব বিন ইসলাম : তালেবানের কাবুল দখলের পরপরই বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সবাই আফগানিস্তান ছেড়ে যার যার দেশে ফিরে যাচ্ছেন। সবমিলিয়ে সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যেহেতু আমরা চেষ্টা করেও দেশে ফিরতে পারিনি, তাই একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমরা কোম্পানিতেই ছিলাম, ভালো ছিলাম। তবে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য দুদিন বের হতে হয়েছিল। আমরা দেখেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। তবে সড়কে মানুষের চলাচল কম ছিল। আসা-যাওয়ার পথে তালেবানের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বোমা হামলার পর আমরা যখন বিমানবন্দর থেকে কাবুলে ফেরত আসছিলাম রাতে বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ ছিল। বাসায় ফেরার পথে বিভিন্ন স্থানে তালেবান গাড়ি থামিয়েছে। গাড়িতে উঠে আমাদের নানা প্রশ্ন করেছে। বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় দেওয়ায় তারা আমাদের ছেড়ে দেয়।

ঢাকা পোস্ট : প্রথম দফায় ফ্লাইট বাতিলের পর ২৪ ঘণ্টার মতো কাবুল বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন। এরমধ্যে বিমানবন্দরে দুটি বোমা হামলা হয়, সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলবেন?

রাজীব বিন ইসলাম : দেশে ফেরার আশায় আমরা ২৫ আগস্ট প্রথম কাবুল বিমানবন্দরের কাছাকাছি গিয়েছিলাম। আত্মঘাতী বোমা হামলার কারণে ওইদিন ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষার পরও বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারিনি। সেদিন আমরা ১৫ বাংলাদেশি এবং চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ১৬০ জন আফগান শিক্ষার্থী বিমানবন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলাম। সাতটি বাসে আমরা বসা ছিলাম। বোমা বিস্ফোরণের পর আমাদের মূল বাণিজ্যিক ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে বলা হয়।  বিস্ফোরণের আগেও আমরা হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের পেছনের সামরিক ফটকের কাছে ছিলাম। ওই ফটক দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছিলাম। নিরাপত্তার ছাড়পত্রসহ আনুষঙ্গিক অনুমতি না থাকায় সেটি দিয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হই।

ঢাকা পোস্ট : কাবুল থেকে দোহায় যাওয়ার ব্যবস্থা হলো কীভাবে?

রাজীব বিন ইসলাম : বিমানবন্দরে প্রবেশের পর আমরা মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে যাই। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। আমরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখিয়ে বলি, দেশে ফিরতে চাই। আমাদের পাসপোর্ট দেখে কর্মকর্তারা কাবুল ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা মার্কিন বিমানবাহিনীর পরের ফ্লাইটটিতে তুলে দেওয়ার আশ্বাস দেন। সেদিন ছিল ২৭ আগস্ট। কাবুল থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীর ওই ফ্লাইটে প্রায় ৬০০ মানুষের মধ্যে আমরাও ছিলাম। ফ্লাইটের বেশিরভাগ লোকই ছিলেন আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। ফ্লাইটটি প্রথমে আমাদের নিয়ে কুয়েতে অবতরণ করে, সেখান থেকে জ্বালানি নেয়। এরপর আবার অবতরণ করে কাতারের দোহায়। সেখানে নামার পর উড়োজাহাজ থেকে গাড়িতে করে আমাদের মার্কিন ঘাঁটিতে নেওয়া হয়। পরের ২৪ ঘণ্টা সেখানেই ছিলাম। এর মধ্যে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের অবস্থান জানাই। আমরা জানাই, এখান থেকে দেশে ফিরতে চাই। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোহা মিশনকে জানায়। দোহার দূতাবাস আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরদিন নিয়ে যায়। আমরা দুদিন থাকি দোহায়। সেখানে করোনার পিসিআর টেস্ট করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয় দূতাবাস। সেখান থেকে আমাদের কোম্পানি টিকিট করে দেয়।

ঢাকা পোস্ট : ৩১ আগস্ট রাতে ঢাকার বিমানবন্দরে নামলেন। দেশে ফিরতে পারার অনুভূতিটা কেমন ছিল?

রাজীব বিন ইসলাম : কয়েক দফা চেষ্টার পর দেশে ফিরতে পারা। যখন কাবুল ছেড়ে দোহায় পৌঁছাই, তখন আমাদের কিছুটা ভালো লাগছিল। আমরা চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু আসতে পারছিলাম না। ঢাকায় আসার পর অবশ্যই ভালো লেগেছে। সেই অনুভূতি তো বোঝানো যাবে না, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে ছিলেন। আফগানরা বাংলাদেশিদের কীভাবে মূল্যায়ন করে?

রাজীব বিন ইসলাম : বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশিদের তাদের কাছে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। তারা বাংলাদেশিদের পছন্দ করে।

এনআই/এসএসএইচ/জেএস