ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের (প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করতে রাজধানীর গুলশান থানায় হাজির হয়েছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। 

তারা ইতোমধ্যে গুলশান থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্ত শেষে এটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। তবে বুধবার রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত অভিযোগটি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ভুক্তভোগীরা থানায় অবস্থান করছেন। 

ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, একজন ৯ লাখ টাকা এবং আরেকজন ৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করেও নির্ধারিত সময়ে তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন / ফাইল ছবি

ভুক্তভোগীদের একজন আরিফ বাকের কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি গত ২৯ মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোটরসাইকেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। এগুলো ৭ থেকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা দেয়নি। কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়ে সমাধান পাইনি। অফিসে গিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বললে খারাপ ব্যবহার করেছে। সিইও রাসেলের সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের সঙ্গে ইভ্যালি চরম দুর্ব্যবহার করেছে। আমার মতো অনেকের একই অবস্থা। তাই আমি থানায় ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করতে এসেছি।

অভিযোগপত্রে আরিফ বাকের উল্লেখ করেন, ইভ্যালিকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য বিকাশ, নগদ ও সিটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করি। আমার মতো আবুল কাশেম ও আবদুল্লাহ ওমর হক নামের ভুক্তভোগীও অনেক টাকার পণ্য কেনেন। নির্ধারিত সময়ে পণ্য না পেয়ে আমরা ধানমন্ডি ১৪ নম্বর রোডে অবস্থিত ইভ্যালির অফিসে যাই। ইভ্যালির সিইও মো. রাসেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমাদের বাধা দেওয়া হয়।

‘১০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টায় আমি ও অন্য ভুক্তভোগীরা আবারও ইভ্যালির অফিসে যাই। তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে পণ্যের অর্ডার সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে অফিসের ভেতরে থাকা ইভ্যালির সিইও রাসেল সাহেব তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ভয়ভীতি দেখান এবং পণ্য অথবা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এ সময় আমাদের প্রাণনাশের হুমকিও দেন তিনি। আমরা চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিনযাপন করছি এবং পণ্যগুলাে না পাওয়ায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা জানতে পারি ইভ্যালি পণ্য বিক্রির নামে নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে আনুমানিক ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। টাকার এই অঙ্ক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তাই আমরা সিইও মো. রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনসহ আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার প্রার্থনা করছি।’

রাজধানীর গুলশান থানায় ভুক্তভোগীরা/ছবি : সংগৃহীত

এ বিষয়ে গুলশান থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন ভুক্তভোগী ইভ্যালির এমডি রাসেলের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ নিয়ে আমাদের থানায় আসেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অফিস ধানমন্ডি থানা এলাকায় হওয়ায় ভুক্তভোগী নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি মামলাটি কোথায় করবেন। যেহেতু অফিসটি ধানমন্ডিতে, নিয়ম অনুযায়ী সেখানেই মামলাটি হওয়ার কথা। তবে, ভুক্তভোগীর বাসা গুলশান এলাকায় হওয়ায় তিনি আমাদের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে এসেছিলেন। তার কাছ থেকে অভিযোগের একটি কপি আমরা রেখে দিয়েছি। তাকে আমরা বলেছি আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে থানায় আসতে। তখন সিনিয়র অফিসাররা থাকবেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। বেশি রাত হওয়ায় ভুক্তভোগীরা এখন বাসায় চলে যাচ্ছেন।

এদিকে, গত মঙ্গলবার ইভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। এদিন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, যেহেতু আইন লঙ্ঘন হয়েছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্ব না নিয়ে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দেবে। তার আগে কমিটির সুপারিশ বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য সচিবকে জানানো হবে।

হাফিজুর রহমান আরও বলেন, ১০টি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছিল। একটি পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর তথ্যও আসবে। বৈঠকে ধামাকা, ই–অরেঞ্জ ইত্যাদির কর্মকাণ্ড নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

ইভ্যালির সম্পদ ও দায়

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে সম্পদ ও দায়ের হিসাব দাখিল করে ইভ্যালি। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তাদের মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকাই কোম্পানিটির চলতি দায়।

ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার এ দুটির যোগফলকে দেখানো হচ্ছে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে।

মোট দায় ৫৪৩ কোটি টাকা থেকে ওই অঙ্ক বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৮ কোটি টাকা। যাকে ইভ্যালি বলছে তার অস্থাবর সম্পত্তি। বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্যমান সম্পত্তি। কোম্পানিটি নিজের ব্র্যান্ড মূল্য নিজেই নির্ধারণ করেছে।

শুধু গ্রাহকদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৩১১ কোটি টাকা। এ দেনা আছে মোট ২ লাখ ৭ হাজার ৭৪১ গ্রাহকের বিপরীতে। এ হিসাব গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত।

এআর/এমএসি/এসকেডি