প্রতীকী ছবি

‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর অপসংস্কৃতি’তে আসক্ত হয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে রাজধানীর পল্লবী থেকে ‘নিখোঁজ’ হওয়া তিন কলেজছাত্রী। অতিরিক্ত পারিবারিক বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে এবং উচ্চবিলাসী জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে জাপান চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। এজন্য জাপানি ভাষাও রপ্ত করে তিন বান্ধবী। পরিকল্পনা ছিল, কক্সবাজার হয়ে নৌপথে জাপান যাবে তারা। এসব তথ্য জানিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। 

র‍্যাব জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করে দেয় তিন শিক্ষার্থী। পরিচয় গোপনের স্বার্থে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করে তারা নিজেদের চুল কেটে ছোট করে ফেলে। নতুন সিম না কিনে কক্সবাজারের একটি হোটেলে উঠে তারা শুধু ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে। 

তবে তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কক্সবাজারে গিয়ে। সমুদ্র সৈকত থেকে তাদের সব ছিনিয়ে নেয় দুই ব্যক্তি। এতে তারা ভয় পেয়ে যায় এবং রাজধানীতে ফিরে আসে। আজ (বুধবার) সকালে তাদের আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব-৪।  

গত ৩০ সেপ্টেম্বর পল্লবীর ১১ নম্বর প্যারিস রোড থেকে ওই তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তারা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, স্কুল সার্টিফিকেট ও মূল্যবান সামগ্রী সঙ্গে করে নিয়ে যায় বলে জানায় ৩ জনের পরিবার।

তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজ ও উদ্ধারের বিষয়ে বুধবার সন্ধ্যায় র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এ ঘটনায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ পুরো দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এরপর পুলিশের পাশাপাশি ছায়াতদন্ত শুরু করে র‍্যাব-৪।

ঘটনার অনুসন্ধান ও ভিকটিমদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিন বান্ধবী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া পড়াশোনা ও ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য পরিবারের চাপে বিরক্ত হয়ে পড়ে তারা।

পরিবারের নিয়ম-কানুন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চবিলাসী জীবন-যাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা অধিক পরিমাণে জাপানি সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে জাপানি ভাষা আয়ত্ত করে নেয়।

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীরা দাবি করে, তারা স্বাধীন জীবন-যাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে। জাপানি সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সম-অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার বিষয়টি তাদের আকৃষ্ট করে।  

তিনি জানান, দুই মাস আগে তিন বান্ধবী তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়িতে ঘুরতে যায়। সেখানে হাফসা চৌধুরী নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ওই নারীর সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানায়। পরে তাদের ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয় এবং হাফসা চৌধুরী তাদের জাপান যেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। 

তিন বান্ধবী পরিকল্পনা মতো কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রিকশায় করে প্রথমে গাবতলী যায়। হাফসার পরামর্শে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলী থাকতেই নষ্ট করে দেয়।

র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, ওই তিন শিক্ষার্থী নৌকায় নদী পার হয়ে আমিনবাজার এলাকায় যায়। সেখান থেকে হাফসার দুজন লোক একটি কালো রঙের নোয়া গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যায়। পরে তাদের রাজধানীর অজ্ঞাত একটি স্থানে নামিয়ে দিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেতে বলে এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তিন বান্ধবী তাদের কথামতো কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন না পেয়ে বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি যায়। 

পথে তারা পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে চুল কেটে পশ্চিমা বেশ ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। এরপর তারা বাসে করে চট্টগ্রাম যায় এবং সেখান থেকে আরও দুটি মোবাইল কিনে কক্সবাজারের উদ্দেশে বাসে ওঠে। 

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা আরও জানান, মোবাইল কিনলেও আত্মগোপনে থাকার জন্য তারা কোনো সিম কেনেনি। ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের কলাতলীর একটি হোটেলে অবস্থান করে তারা। সেখানে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার সৈকত এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ ও শফিক নামে দুজন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে নেয়।

এ ঘটনায় তিন বান্ধবী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ২ দিন হোটেলেই অবস্থান নেয়। পরে তারা হোটেলের আশপাশে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত নয়টার দিকে ছদ্মবেশে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। আজ সকালে ঢাকার আব্দুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছায় তারা। পরে র‍্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে।

হাফসা চৌধুরীকে শনাক্ত করা গেছে কি না জানতে চাইলে র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, মোবাইল নম্বর বা অন্য কোনো তথ্য না থাকায় এখন পর্যন্ত তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে তাকে শনাক্ত করা, নোয়াহ গাড়িতে থাকা দুই ব্যক্তি ও কক্সবাজার সৈকতে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া ওই দুই ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উদ্ধার হওয়া তিন শিক্ষার্থীকে তাদের পরিবারের উপস্থিতিতে পল্লবী থানায় হস্তান্তর করা হবে বলে জানান র‍্যাবের এ কর্মকর্তা।

জেইউ/আরএইচ/জেএস