বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে প্রাইমারিতেই শেষ হয়ে যায় নজরুল ইসলাম সোহাগের পড়াশোনা। এরপর তিনি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে আসেন ঢাকার মতিঝিলে। ছিন্নমূল শিশুদের সঙ্গে শুরু হয় ওঠা-বসা। একসময় তিনি চুরিতে জড়িয়ে পড়েন। 

একটি দুটি করে চুরি করতে করতে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাকা চোর হয়ে ওঠেন। বছর দুয়েক আগে তিনি নিজেই আলাদা চোরচক্র তৈরি করেন। তিন সদস্যের চক্রের দুজনকে নিরাপত্তার জন্য বাইরে রেখে তিনি একাই বাসা-বাড়িতে চুরির জন্য ঢুকে কাজ সেরে পালিয়ে যেতেন। 

চুরিবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত সোহাগ বলছেন, শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি চুরি তিনি একাই করেছেন। চোরাই মালামাল বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন দেড় কোটিরও বেশি টাকা। এর বেশির ভাগ টাকাই তিনি উড়িয়েছেন হেরোইন আর ইয়াবার নেশা করে।

একটি চুরির রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে দীর্ঘ দেড় মাসের চেষ্টায় নজরুল ইসলাম সোহাগের সন্ধান পায়  ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগ।

বুধবার রাতে রাজধানীর বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালের সামনে থেকে সোহাগ ও একই চক্রের সদস্য জুয়েলকে গ্রেফতার করে ডিবি গুলশান পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিম। এ সময় উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছয়টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন মডেলের আটটি মোবাইল, দামি হাত ঘড়ি ও দুটি ক্যামেরা।

ডিবি গুলশান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সোহাগের নামে রয়েছে একাধিক মামলা। সর্বশেষ একটি চুরির ঘটনায় গত রমজানের ঈদে গ্রেফতার হয়ে দেড় মাস কারাভোগও করেন সোহাগ। জামিনে বেরিয়ে ফের শুরু করেন চুরি। জেল থেকে বেরিয়ে সোহাগ শূন্য হাতেই গ্রিল ভেঙে ২৯টি চুরি করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে ডিবি।

গত ২৮ জুলাই বনানীর ই ব্লকের ১৩ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাসায় ৩বি ফ্ল্যাটে মোবাইল ল্যাপটপ ও স্বর্ণালঙ্কারসহ সাড়ে তিন লাখ টাকার মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৩০ জুলাই ব্যবসায়ী এ এ এম এম সামসুজ্জামান বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার তদন্তভার পাওয়ার দেড় মাস পর সন্ধান মেলে সোহাগের।

এরপর গত ২১ সেপ্টেম্বর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় চুরির ঘটনা ঘটান সোহাগ। সে ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী ওয়াহিদুল ইসলাম।

গ্রেফতার জুয়েল

যেভাবে সন্ধান মেলে সোহাগের

একটি চোরাই মোবাইল উদ্ধারের তথ্য বিশ্লেষণ করে উঠে আসে চোর একটি চক্রের মূলহোতা সোহাগের নাম। সাধারণত গ্রিল কেটে চুরির কথা শোনা গেলেও সোহাগ গ্রিল ভেঙে বা হাতের কসরতে বাঁকিয়ে বাসায় ঢুকে চুরিতে অভ্যস্ত। অন্য চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায় মাত্র তিন সদস্যের চোরচক্রটিকে শনাক্তে অনেক তল্লাশি ও অভিযান পরিচালনা করতে হয় ডিবি পুলিশকে।

ডিবি গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এসএম রেজাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একটি চুরির পর আরেকটি চুরি করতে সময় নিতেন সোহাগ। এক চুরির মালামাল বিক্রির অর্থ শেষ হলেই নেমে পড়তেন আরেকটি চুরির লক্ষ্যে।

যেভাবে চুরির কাজে জড়িয়ে পড়েন সোহাগ

সোহাগের বাড়ি চাঁদপুর হাজীগঞ্জে। ছোটবেলায় বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকায় আসেন। জায়গা হয় মতিঝিলের কাগজের মাঠে। সেখানেই কাগজের টোকাইদের সঙ্গে শুরু হয় ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া। সেখানকার চোর টোকাইদের সঙ্গে মিশে ধীরে ধীরে একটি-দুটি করে চুরির কাজে যোগ দেন তিনি। এরপর ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ শীর্ষ চোরের হাত ধরে পাকা চোর হয়ে ওঠেন। বছর দুয়েক আগে নিজেই আলাদা চোরচক্র তৈরি করেন।

রাতে পিকআপ চালিয়ে চুরির বাসা রেকি

তিন সদস্যের চোরচক্রের প্রধান সোহাগ। বাকি দুজনের মধ্যে গ্রেফতার জুয়েল সবসময় থাকতেন সোহাগের সঙ্গেই। আরেক সদস্য পলাতক মানিক থাকতেন পিকআপে। বাসা রেকির পর বাকি দুজনকে নিরাপত্তার জন্য বাইরে রেখে সোহাগ একাই যেতেন বাসা-বাড়িতে চুরি করতে।

দুর্বল নিরাপত্তা-ঘুমন্ত রক্ষীর বাসায় খুঁজতেন সোহাগ

রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, টঙ্গি, মিরপুর বেড়িবাঁধ, খিলক্ষেত, বনানী, গুলশান এলাকার বাসা রেকি করতেন সোহাগ। এ সময় তিনি খেয়াল করতেন দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা নেই কিংবা অন্ধকার বাসা। নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তারক্ষী ঘুমন্ত থাকলে তো কথাই নেই। চোখের নিমিষে সোহাগ উঠে যেতে পারেন ভবনের ১০ থেকে ১২ তলা পর্যন্ত।

গ্রেফতারদের কাছ থেকে জব্দ করা মালামাল

গ্রিল কেটে নয়, ভেঙেই ভেতরে বাসায় ঢুকে চুরি

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এসএম রেজাউল হক বলেন, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সোহাগ জানিয়েছেন, গ্রিল কেটে নয়, ভেঙেই তিনি প্রবেশ করতেন বাসা-বাড়িতে। এক্ষেত্রে তিনি সবসময় দেখতেন কোন বাসার গ্রিলের লোহা চিকন ও পাতলা। হাতের কসরতে গ্রিল বাঁকা করে বাসায় ঢুকে নিমিষেই চুরির কাজ শেষ করে বেড়িয়ে যেতেন। এভাবে এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি চুরি তিনি একাই করেছেন। চোরাই মালামাল বিক্রি করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন দেড় কোটির বেশি টাকা।

চোরাই মোবাইল-ল্যাপটপ গুলিস্তানে, স্বর্ণালংকার তাঁতীবাজারে বিক্রি

সোহাগ চোরাই মোবাইল ও ল্যাপটপ বিক্রি করতেন রাজধানীর গুলিস্তান পাতাল মার্কেট ও সুন্দরবন মার্কেটে। আর চোরাই স্বর্ণালংকার বিক্রি করতেন তাঁতীবাজারে। আরামবাগের পাশে একটি মাঠে অন্য চোরদের সঙ্গে আড্ডাও দিতেন সোহাগ।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোহাগ খুবই ধুরন্ধর, অত্যন্ত চৌকস, চুরিতে এককথায় সিদ্ধহস্ত। তার সন্ধান করতেই আমাদের দেড় মাসের বেশি সময় লেগেছে। দেড় কোটির বেশি টাকার সম্পদ তিনি চুরি করেছেন। কিন্তু সেসব চোরাই মালামাল বিক্রির টাকায় হেরোইন আর ইয়াবায় বুঁদ হয়ে থাকত। চক্রের অন্য সদস্য পলাতক মানিকের দুটি পিকআপ তিনি ব্যবহার করতেন। এজন্য মানিক পেতেন চুরির ১০ থেকে ২০ শতাংশ।

শীর্ষ দুই চোর সরদারকে খুঁজছে ডিবি পুলিশ

মশিউর রহমান বলেন, শত শত টোকাইকে চোর বানিয়েছেন দুই চোর গুরু। তাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। তারা টোকাই, বাস্তুহারা তরুণ-যুবকদের চুরির কাজে ট্রেন আপ করেন। চোরাই মালামাল বিক্রি ও লেনদেন করেন তারা। তাদের বের করা সম্ভব হলে রাজধানীতে চুরির সংখ্যা কমে আসবে।

জেইউ/আরএইচ