২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তিন দফায় কন্টেইনারভর্তি বালু ও মাটি জব্দ করা হয়। সেসব কন্টেইনারে চীন থেকে তুলা আমদানির কথা ছিল। ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি আবারও সাড়ে ২৩ হাজার কেজি সুতার পরিবর্তে জব্দ করা হয় বালুর বস্তা। এর কিছুদিন পর ৪ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনারভর্তি বালুর বস্তা আসে। অথচ এসব কন্টেইনারে ৪৯ হাজার ৬৯৭ ডলার মূল্যের সুতা আসার ঘোষণা ছিল।

সর্বশেষ চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি কন্টেইনারভর্তি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট জব্দ করে কাস্টমস। ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল অ্যান্ড কেমিক্যাল ফাইবার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে কাপড় ও কাপড়ের সরঞ্জাম আনার ঘোষণা দিয়ে এক কোটি ১৩ লাখ সিগারেট (শলাকা) আমদানি করে। যেখানে শুল্ক-করসহ ২৭ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা হয় বলে জানায় কাস্টম কর্তৃপক্ষ।

কাস্টমের চোখের সামনেই দিনের পর দিন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটছে। সংঘবদ্ধ একটি জালিয়াতি চক্র নানা অপকৌশলে একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, অন্যদিকে দেশ থেকে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থপাচার

কাস্টমের চোখের সামনেই দিনের পর দিন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটছে। সংঘবদ্ধ একটি জালিয়াতি চক্র নানা অপকৌশলে একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, অন্যদিকে দেশ থেকে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থপাচার।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪২৯টি মিথ্যা ঘোষণা শনাক্ত করে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ। একটি শক্তিশালী চক্র পণ্য আমদানিতে মূল্যের অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন, পরিমাণ, গুণগতমান প্রভৃতি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রতারণা করে আসছে প্রতিনিয়ত। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লেও তা থেকে রক্ষা পেতে বন্দরের অসৎ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময় নথি গায়েব করার নজিরও মিলছে।

অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়

২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর নয়াবাজারে ‘আল-আমিন মেরিটাইম ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেলস ফ্যাশন’ নামের এক পোশাক কারখানা থেকে ৬৫টি গোপন নথি উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। যদিও প্রতিটি অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। কিন্তু দেখা যায়, অনেকটা দায়সারা মামলা করা হয়। বড় ধরনের শাস্তির উদাহরণ এখনও দেখা যায়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা অনুসন্ধানে নথি গায়েব ও মিথ্যা ঘোষণার সঙ্গে কাস্টম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি যোগসাজশের বেশকিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টম কর্মকর্তাদের পারস্পরিক যোগসাজশে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র।

দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ থেকে টিম গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে

দুর্নীতির এমন গুরুতর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া কমিশনের এক আদেশে বলা হয়েছে, কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ লোপাটে নথি গায়েব করে আসছে। চক্রটি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিপিং ডকুমেন্ট জালিয়াতি করছে। দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ থেকে টিম গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকি কিংবা বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের অভিযোগ নতুন নয়। এ বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না— এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে সরকারি অর্থ আত্মসাতের যেকোনো ঘটনা তফসিলভুক্ত অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করে থাকে।

মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি জালিয়াতি ও নথি গায়েবের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণার ক্ষেত্রে আমরা দ্বিগুণ ও তিনগুণ অর্থ জরিমানা করি। বড় ধরনের জালিয়াতির ক্ষেত্রে জরিমানার পাশাপাশি ফৌজদারি আইনে মামলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং আইনে তদন্ত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরে এমন অনেক জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। কাস্টমের অসাধু কর্মকর্তারা দুর্নীতির প্রমাণ মুছতে নথিও গায়েব করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটান

অনিয়মের সঙ্গে আপনাদের কোনো কর্মকর্তা যদি জড়িত থাকে সেক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে যদি আমাদের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাই, তাহলে অবশ্যই আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যে-ই হোক।

এমন জালিয়াতিতে আদালতের রায়ে সাজা হয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগে। মানি লন্ডারিং আইনে এনবিআর ক্ষমতা পেয়েছে কিন্তু সেটা বেশিদিন হয়নি। আমার জানা মতে, কোনো মামলায় সাজা হয়নি।’ 

দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন যা বলছে

দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মালামাল আমদানিতে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে। বিষয়টি ধরা পড়ার পর এর দায় থেকে রক্ষা পেতে বন্দরের অসৎ কর্মকর্তাগণের যোগসাজশে নথি গায়েব করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাগণের যোগসাজশে রিপোর্ট পরিবর্তন বা স্বাক্ষর জাল করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে নয়টি বিল অব এক্সচেঞ্জ (বি.ই) এর বিপরীতে নয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি গায়েব এবং পাঁচটি বি.ই-এর বিপরীতে তিন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বাক্ষর জাল এবং রিপোর্ট পরিবর্তনের প্রমাণে পাওয়া গেছে। বেশি শুল্ক পরিশোধযোগ্য মালামাল আমদানি করে কম শুল্কের পণ্যের কোড ব্যবহার করে আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টম কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে সরকারের লাখ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪২৯টি মিথ্যা ঘোষণা শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ।

দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম। এ বন্দর দিয়েই অধিকাংশ আমদানি-রফতানির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়

নথি গায়েব করে পণ্য খালাসের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির কয়েকটি নমুনা

মন ট্রিমস লিমিটেড, এম এ থ্রেড অ্যান্ড এক্সেসরিজ, নাসা তাইপি টেক্সটাইল মিল, এমএস সানজানা ফেব্রিক্স লিমিটেড, ব্লু ওসেন ফুটওয়্যার লিমিটেড, জেকে নিট কম্পোজিট লিমিটেড, নিট এশিয়া লিমিটেড, আসওয়ার্ড কম্পোজিট মিলস লিমিটেড ও প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল লিমিটেড— এসব আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্যের নাম ও এইচএস কোড ঘোষণায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ধরা পড়ে। প্রকৃত এইচএস কোডের ভিত্তিতে অতিরিক্ত রাজস্ব পরিশোধ না করে এবং মিথ্যা ঘোষণার দায়ে বন্ড সুবিধা বাতিলের হাত থেকে বাঁচতে নথি গায়েব করা হয়।

স্বাক্ষর জাল ও প্রতিবেদন পরিবর্তন করে পণ্য খালাসের কয়েকটি নমুনা

কাইসিং ফুড লিমিটেড, এমএইচ অ্যাপারেটস লিমিটেড ও নাসরিন জামান নিটওয়্যারের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির বিষয়টি প্রমাণিত হয়। অতিরিক্ত রাজস্ব পরিশোধ এবং মিথ্যা ঘোষণার দায়ে বন্ড সুবিধা বাতিলের হাত থেকে বাঁচতে স্বাক্ষর জাল করে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদন পরিবর্তন করা হয়।

অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের বিষয়ে দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, গোপন অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযোগসমূহের সত্যতা পাওয়া যায়। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাস্টম হাউসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক পরস্পর যোগসাজশে কম রাজস্বের এইচএস কোড উল্লেখ করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করছে। পরে রাসায়নিক পরীক্ষায় মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার দায় থেকে বাঁচার জন্য নথি গায়েব করে বা স্বাক্ষর জাল করে পণ্য খালাসের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগটি ‘সঠিক’ প্রতীয়মান হওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করা সমীচীন— অভিমত দুদকের।

এ বিষয়ে দুদকের গোয়েন্দা প্রধান ও পরিচালক জয়নুল আবেদীন শিবলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাস্টম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের বেশকিছু প্রমাণ মিলেছে

এর আগে ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে বেশকিছু সুপারিশ পাঠায় দুদক। মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো সুপারিশে কাস্টম হাউসগুলোর ব্যাপক প্রচলিত অনিয়মের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, পণ্য আমদানিতে এর মূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন, পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই প্রকার পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় থেকে সরকারকে বঞ্চিত করছে কাস্টম হাউসগুলো। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয় ওই সুপারিশে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সূত্র অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে অর্থপাচারের হার সবচেয়ে বেশি। আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে বিশেষত যেসব পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কম যেমন- মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটারসামগ্রী ইত্যাদি বা যেসব পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ করা কঠিন সেসব পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচার হয়ে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পাচার হওয়া অর্থের ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

আরএম/এমএআর/