ভোলা সদর উপজেলার কন্দ্ৰকপুর গ্রামের কৃষক মো. হানিফ খলিফার মেয়ে সারমিন বেগম (২৩)। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অভাবের সংসার আর অসুস্থ মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে গিয়ে পড়াশোনাকে বিসর্জন দিতে হয় তাকে। একপর্যায়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে ২০১৪ সালের নভেম্বরে নির্মাণ শ্রমিক ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই ২০১৬ সালে তাদের পরিবারে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।

একপর্যায়ে স্বামীর বিরূপ আচরণ ও লাগামহীন নির্যাতনের কারণে ২০১৮ সালে টঙ্গীর একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি নেন তিনি। এরপর থেকে তার স্বামী সংসারের ভরণপোষণ একেবারেই বন্ধ করে দেয়। ফলে বাড়ি ভাড়া, সন্তানের ভরণপোষণ, খাওয়া-পরাসহ সব খরচ সারমিনকেই বহন করতে হয়। এসব নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এবং তার ওপর নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যায়। একদিন ঝগড়ার একপর্যায়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে মাথায় আঘাত পান সারমিন। এ কারণে প্রায় তিন মাস কথা বলার ক্ষমতা হারান তিনি।

বর্বরতার এখানেই সমাপ্তি নয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে কথা বলতে না পারায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও লাইফ কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সারমিনকে ফেলে রেখে তার স্বামী চলে যায় এবং বহুদিন তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

দীর্ঘদিন অভাব, অসুস্থতা নিয়ে জীবনযুদ্ধ করে অবশেষে গার্মেন্টসের আরেক সহকর্মীর মাধ্যমে খোঁজ পান ব্র্যাক সেবাকেন্দ্রের। জানতে পারেন এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি আইনি সেবাও পাওয়া যায়। এরপরই বদলে যায় সারমিনের জীবন। ব্র্যাকের চিকিৎসা ও সহযোগিতায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবারও কাজে ফেরেন তিনি। আইনি সহায়তায় ফিরে পেয়েছেন পরিবার এবং ঘরে ফিরেছে সুখের আলো।

ব্র্যাকের ওয়ান স্টপ সার্ভিস স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কারিগরি ও আইনি সহায়তাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমে গার্মেন্টস কর্মী সারমিন বেগমের মতো অসংখ্য নারীর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ব্র্যাক ইউডিপি কর্মসূচির আওতায় ‘এম্পাওরিং দ্যা রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়ার্কার লিভিং ইন আরবান ভ্রামস অব ঢাকা’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটি নতুন শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন করা, প্রধানত নারী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, জব রেফারেলের ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আইনগত সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থাৎ, গার্মেন্টস কর্মীরা ব্র্যাকের একটি সেন্টারে এসেই প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে আইনি সেবাসহ বিভিন্ন সেবামূলক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আর একই ছাতার নিচে সব সেবা কার্যক্রমের এ পদ্ধতিকেই বলা হয়ে থাকে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’।

এদিকে জীবনের এমন কণ্টকাকীর্ণ বিস্তর পথ পাড়ি দেওয়া প্রসঙ্গে গার্মেন্টস কর্মী সারমিন বলেন, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর ২০১৯ সালের জুন মাসের দিকে সন্তানসহ আমি ব্র্যাক সেবাকেন্দ্রে আসি চিকিৎসা নিতে। সেবাকেন্দ্রের ডাক্তার আপার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে আমিসহ আমার সন্তান সুস্থ হয়ে যাই।

তিনি বলেন, ব্র্যাক সেবাকেন্দ্রে এসে আমি আরও জানতে পারি যে এখানে গার্মেন্টস কর্মীরা সাশ্রয়ী মূল্যে ডিপিএস ও স্বাস্থ্য বিমার সেবা পেয়ে থাকে। তখন প্রথমে আমি সঞ্চয়ের জন্য একটি ডিপিএস অ্যাকাউন্ট করি। পরে ডাক্তার আপার পরামর্শে আমি নিজের উন্নত চিকিৎসার জন্য একটি স্বাস্থ্য বিমাও করি।

‘স্বাস্থ্য বিমার কার্ড নিয়ে আমি আবেদা মেমোরিয়াল হসপিটালে গেলে সেখানে বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাই এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী সিটি স্ক্যান করে দেখা যায় আঘাতের কারণে আমার ব্রেইন কিছু ক্ষতির শিকার হয়েছে। আবেদা মেমোরিয়াল হসপিটালের নিউরোলজিস্টের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আমি ব্র্যাক সেবাকেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ওষুধ নিয়ে সেবন করে সুস্থ হয়ে উঠি’, যোগ করেন সারমিন।

পরিবার প্রসঙ্গে এ নারী গার্মেন্টস কর্মী আরও বলেন, আমার স্বামী ইতোমধ্যে আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করে এবং আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে পুনরায় সংসার করার ইচ্ছা-পোষণ করে। কিন্তু আমি এ বিষয়ে দ্বিধায় ভুগতে থাকি। কারণ আমার পরিবারও চাচ্ছিল না যে আমি তার সঙ্গে আবার সংসার শুরু করি। এরপর আমার বোনের সঙ্গে আমি ব্র্যাক সেবাকেন্দ্রে আইনি সহায়তা নিতে আসি আমার স্বামীর বিষয়ে একটা সমাধানের আশায়।

সারমিন বলেন, সেবাকেন্দ্র দুই পক্ষ মিলে বিষয়টা মীমাংসা করার পরামর্শ দেন। মীমাংসা না হলে প্রয়োজনে আমি ব্র্যাকের মাধ্যমেই বিনা খরচে আদালতে মামলা করতে পারব বলে জানায়। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও মীমাংসায় রাজি হই এবং উভয়পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সংসার পুনরায় স্থাপিত হয়। কিন্তু শর্ত থাকে যে সে নিয়মিত আমার ও সন্তানের ভরণপোষণ বহন করবে এবং আমাকে আর কোনো নির্যাতন করবে না। অন্যথায় আদালতের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্তমানে আমি দুই কন্যা সন্তানের জননী এবং স্বামীসহ সুখেই বসবাস করছি।

ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রসঙ্গে ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এসকে মুজিবুল হক বলেন, আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে এক জায়গায় অনেকগুলো সেবা দিয়ে যাচ্ছি আরএমজি ওয়ার্কারদের জন্য। আর এ সেবাগুলো তাদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এটি আমাদের একটি পাইলট প্রজেক্ট, যা ২০২২ সাল পর্যন্ত চলবে।

তিনি বলেন, ঢাকার সাভার মিউনিসিপালিটি এবং গাজীপুর জেলার সিটি করপোরেশনের গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় গার্মেন্টস কর্মী আধিক্য রয়েছে। এ দুটি এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর অন্যতম প্রধান কার্যক্রম হলো বিদ্যমান সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে নগর দারিদ্র্য হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া, গার্মেন্টসে দরিদ্র কর্মীর বিশেষ করে গার্মেন্টসে নারী কর্মীদের মৌলিক সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং তাদের আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তোলা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বিকাশ করা এবং দরিদ্রবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন নিশ্চিত করার জন্য অ্যাডভোকেসি করা।

মুজিবুল হক বলেন, এ প্রকল্পটির মেয়াদ এ বছরই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত করেছে। একসময় আমাদের এ প্রকল্প শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এ ধরনের প্রকল্প যদি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সরকার বা বিভিন্ন মহল থেকে গ্রহণ করা হয়, তাহলে আরএমজি ওয়ার্কারদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। যারাই এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসবে, আমরা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের সবকিছু দিয়ে সহযোগিতা করব।

টিআই/এসএসএইচ