রাজধানীবাসীর আয়ের সিংহভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া পরিশোধে। অতিরিক্ত ভাড়ার এ শহরে তবুও বাস করতে হয় শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদে। বিষয়টি এক ধরনের চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাড়াটিয়াদের জন্য। তারা বলছেন, এ চাপ আর সইতে পারছেন না।

করোনা মহামারিতে অতিরিক্ত বাড়িভাড়ার এ শহরে অনেকেই হারিয়েছেন আয়ের একমাত্র পথ। চাকরি হারানোদের অধিকাংশই ধারদেনা করে বাড়িভাড়া পরিশোধ করেছেন। অনেকে আবার না পেরে বাসা ছেড়েছেন, কেউ কেউ পরিবার নিয়ে ছেড়েছেন রাজধানী।

এমন অবস্থায় রাজধানীর অনেক বাড়ির সামনে ‘টু লেট’ বিজ্ঞপ্তি সেঁটে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ফাঁকা থাকলেও মালিকরা ভাড়ার অতিরিক্ত অংশ কমাচ্ছেন না। নতুন বছরও আসন্ন। আবারও বাড়বে ভাড়া। এ ভাবনা থেকেও অনেকে অতিরিক্ত ভাড়ার বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি এলাকা ও পাড়া-মহল্লার বেশির ভাগ বাসায় ‘টু লেট’ বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো রয়েছে। অলিগলি সর্বত্রই বাসাভাড়ার পোস্টার। বাড়তি ভাড়া নিয়ে কী ভাবছেন ভাড়াটিয়া-মালিকরা, এত বিজ্ঞপ্তি কেন— এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট।

বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলম। ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালেও শত কষ্টের মাঝে বাসাভাড়া পরিশোধ করেছি। বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে ভাড়া বাড়বে। বেতনের সিংহভাগ তো ভাড়া পরিশোধে চলে যায়। এরপরও যদি ভাড়া বাড়ে, তাহলে তো আমাদের মতো স্বল্প আয়ের লোকজন আর থাকতে পারবে না। তাই বর্তমান বাসা ছেড়ে একটু ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছি। যাতায়াতে কষ্ট হবে, তারপরও অতিরিক্ত ভাড়ার চাপ তো কমবে।

রাজধানীর মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, এত ‘টু লেট’ বিজ্ঞপ্তি আগে কখনও দেখিনি। এর কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমটি হলো, নতুন বছরে বাড়িভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা। দ্বিতীয়টি হলো, করোনাকালে আয়-রোজগার কমে যাওয়া। এ দুই কারণে অনেকে বেশি ভাড়ার বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন। ফলে অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা হয়েছে বা হচ্ছে, এত ‘টু লেট’ দেখা যাচ্ছে।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার রিকশাচালক খোরশেদ আলম বলেন, এ এলাকার যে বাড়ির সামনে যাত্রী নামাই, সেখানেই দেখি ‘টু লেট’। অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। করোনা শুরুর পর এত ‘টু লেট’ দেখা গিয়েছিল, এখন আবার দেখা যাচ্ছে।

রাজধানীর বনশ্রীতে ভাড়াবাসায় থাকেন জাহিদুর রহমান। বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বেতন পাই ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাসাভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেই চলে যায় ১৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বেতনের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ভাড়ার পেছনে।

‘ছেলে-মেয়ের স্কুল, আমার অফিস— সবমিলিয়ে কাছাকাছি থাকতে হয়। এ কারণে এখানে বাসাভাড়া নেওয়া। এখন শুনছি সামনে ভাড়া আরও বাড়বে। কিন্তু বেতন বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। তা-ই চিন্তায় আছি। এখানকার (বনশ্রী) কোনো ফ্ল্যাটই ১২/১৪ হাজারের কম নয়। এদিকে সংসারের খরচ যে কমাব, সেই উপায়ও নাই। সবকিছুরই বাড়তি দাম। বাজারে কোনো সবজি ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। আমাদের মতো মানুষ কীভাবে এ শহরে টিকে আছে, কেবল আমরাই ভালো জানি।’

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের যে দাম বেড়েছে, সেই তুলনায় বাড়িভাড়া বাড়ার হার প্রায় দ্বিগুণ।

সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসাভাড়া পরিশোধে।

রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডার বাড়ির মালিক আব্দুল আওয়াল মিয়া। ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা চাকরি করেন, তাদের কি নতুন বছরে বেতন বাড়ে না? একটি পণ্য আগে যে দামে কিনেছেন, সেটার কি দাম বাড়েনি? তাহলে আমরা যারা বাড়ির মালিক, যাদের আয়-রোজগারের পথ বলতে নিজেদের বাড়ির ভাড়া, তারা কি বছর শেষে ভাড়া বাড়াতে পারে না?

তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে; তাহলে কেন আমরা বাড়িভাড়া বাড়াব না? করোনাকালে দীর্ঘ সময় আমার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। এখনও ফাঁকা আছে। আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে। মাস শেষে বাড়ি তৈরির লোনও পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমাদের কথা তো কেউ ভাবে না।

উত্তরার ১১নং সেক্টরের বাড়ির মালিক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক মাস ধরে আমার দুটি ফ্ল্যাট ফাঁকা। জানুয়ারি থেকে ফ্ল্যাট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন এক ভাড়াটিয়া। অনেকে কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন। এ কারণে করোনার পর ‘টু লেট’-এর বিজ্ঞপ্তি এত বেশি।

ভাড়া বেশি হওয়ায় ভাড়াটিয়ারা চলে যাচ্ছেন, এটি কমানো যায় কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকায় বাড়িভাড়া তুলনামূলক বেশি। আসলে ইচ্ছা থাকলেও আমাদের করার কিছু নাই। এ বাড়িই আয়ের একমাত্র উৎস। জীবনের সব আয় দিয়ে এ বাড়ি তৈরি করেছি। ব্যাংকের লোনও আছে। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল, বাড়ির লোন; সঙ্গে সংসার, বাচ্চাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ। ওপর থেকে আমরা বাড়ির মালিক, ভেতরে ভেতরে আমাদেরও টানাটানি চলছে— এটা কেউ বোঝার চেষ্টা করেন না। করোনার মধ্যে যারা ছিলেন (ভাড়াটিয়া), তাদের কিছুটা হলেও ছাড় দিয়েছি কিন্তু এখন আর পেরে উঠছি না।

করোনার মধ্যে আসলেই কি ঢাকার বাড়ির মালিকরা বাসাভাড়ার বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, রাজধানীর বাড়ির মালিকরা কতটা নির্দয়, তার প্রমাণ মিলেছে করোনাকালে। তখন ভাড়াটিয়ারা অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকলেও তারা (বাড়ির মালিকরা) ভাড়াটিয়াদের এতটুকুও ছাড় দেননি।

ন্যায্য ভাড়া বাস্তবায়নে কী প্রয়োজন— উত্তরে সুলতান বাহার বলেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশের ভাড়াটিয়ারা আজ নিষ্পেষিত। কোনো নিয়মনীতি না মেনে বাড়ির মালিকরা যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। রাজধানীর লাগামহীন বাসাভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের রক্ষা করতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা। এমন সব দাবি নিয়ে আমরা বারবার মাঠে নেমেছি, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছেন না।’

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ১১তম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।

এএসএস/আরএইচ/এমএআর/