‘লোকে বলে আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী, কিন্তু আমি তা মানতে নারাজ। শরীরের প্রতিবন্ধকতা কোনো প্রতিবন্ধকতাই নয়, যদি তা মনে ভর না করে।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা জিয়াউল হক।

টানাটানির সংসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর এগোতে পারেননি জিয়াউল হক। এসএসসি শেষে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। চাকরির তিন বছর ভালোই চলে। হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দুই বছর পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার পর লোকজন তাকে শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাবতে থাকে। তবে তিনি লোকের কথা মানতে নারাজ।

জিয়াউল হক বলেন, আমি নিজেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাবতে চাই না। আমিই ছিলাম পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। শরীরের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। শরীরে বল না থাকলেও মনে সাহস জোগাতেই হবে।’

এর মধ্যেই দেশে চালু হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কার্যক্রম। নিজ ইউনিয়ন হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন জিয়াউল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জিয়াউলকে। ডিজিটাল সেন্টারই বদলে দিয়েছে তার জীবন।

সম্প্রতি জিয়াউল হকের গল্প শুনেছে ঢাকা পোস্ট। নিজের স্বপ্নযাত্রা সম্পর্কে বলেছেন তিনি।

ঢাকা পোস্ট : ডিজিটাল সেন্টারে আপনার শুরুটা জানতে চাই।

জিয়াউল হক : ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন । তখন আমাদের ইউনিয়নেও এ কার্যক্রম চালু হয়। হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা আমাকে  তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে বলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।

ওই নভেম্বরেই হুজুরীপাড়া ইউপি তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের (বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার- ইউডিসি) উদ্যোক্তা হিসেবে স্বপ্নের পথে পদচারণা শুরু হয়। তখন এ কেন্দ্র তেমন পরিচিতি পায়নি। এ সম্পর্কে মানুষের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। আমি সবাইকে শোনাতে থাকি ডিজিটাল বাংলাদেশের কাহিনী। আমার সম্পর্কে অনেককে বলতে শুনেছি, আমি নাকি ডিজিটাল পাগল। এ অবস্থায় প্রথম মাসে আমার আয় হয় মাত্র এক হাজার ৬৪৬ টাকা।

ঢাকা পোস্ট : মানুষকে কখন ডিজিটাল সেন্টার সম্পর্কে বোঝাতে পারলেন?

জিয়াউল হক : ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় পোস্টারিং এবং প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ডিজিটাল সেন্টার সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে শুরু করি। আমাদের বিভিন্ন সেবা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করি। পাশাপাশি শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিই।

চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের সেবা নামমাত্র মূল্যে, সময়মতো ডেলিভারি- এসব সুবিধার কারণে সবাই এ কেন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় । এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ বিভিন্ন প্রকার সনদ আমার মাধ্যমে প্রস্তুত ও বিতরণ শুরু হয় । পাশাপাশি অনলাইনে যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রিন্ট, কম্পিউটার কম্পোজ, দলিল লেখা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ফোনের মেমোরি লোডসহ নানা সেবা দিয়ে আমার ভালো আয় হতে থাকে।

ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার থেকে কী ধরনের সেবা পাওয়া যায়?

জিয়াউল হক : বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন আড়াইশর বেশি মানুষ ডিজিটাল সেন্টারে আসেন এবং সেবা নেন।  বিদ্যুৎ বিল, জমির পর্চা, নাম জারি, ভূমিকর দেওয়া, মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, অনলাইনে পাসপোর্ট ও ভিসার আবেদন ফরম পূরণ, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন, কুরিয়ার সার্ভিস, অনলাইনে টিআইএন আইডি খোলা, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ আইটিনির্ভর বিভিন্ন সেবা পাচ্ছেন তৃণমূলের জনগণ।

ঢাকা পোস্ট : শুরু থেকে এ পর্যন্ত  ডিজিটাল সেন্টারের অগ্রগতি কতটা?

জিয়াউল হক : প্রথমে দুটি ডেস্কটপ, একটি ল্যাপটপ এবং ৫০ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করি। এখন ডিজিটাল সেন্টারে আটটি ডেস্কটপ, দুটি ল্যাপটপ, দুটি ফটোকপি মেশিন, দুটি কালার প্রিন্টার, তিনটি লেজার প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, একটি লেমিনেটিং মেশিন, একটি স্পাইরাল মেশিনসহ কয়েক লাখ টাকার সরঞ্জাম ও আসবাব রয়েছে।

এ পর্যন্ত ৪৭৬ জনকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শেষে ডিজিটাল সেন্টার থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে।  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৭  শিক্ষার্থী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পাঁচজন চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি কারিগরি বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত। সেবার পরিধির সঙ্গে বেড়েছে সেন্টারের আয়। প্রথমে আমি একাই শুরু করলেও পরে রুবিয়া বেগম নামে এক নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে শুরু করি। এখন আমাদের সঙ্গে কাজ করছে আরও তিন জন। মোট পাঁচজন কাজ করছি ইউডিসিতে। প্রতিদিন গড় আয় তিন হাজারের বেশি। আর প্রতি মাসে গড়ে সেন্টার থেকে আয় হচ্ছে নব্বই হাজার টাকার বেশি।

ঢাকা পোস্ট : কাজের পরিধি বাড়াতে নতুন কোনো উদ্যোগ আছে?

জিয়াউল হক : ২০১২ সালে বিভিন্ন জেলার ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের নিয়ে ‘রিয়েল এন্ট্রাপ্রেনর’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করি, যা ২০১৮ সালে জয়েন্ট স্টক থেকে সরকারি অনুমোদন নিয়ে ‘রিয়েল এন্ট্রাপ্রেনর লিমিটেড’ নামে রূপান্তরিত হয়েছে।

২০১৪ সালে ‘গ্রামের হাট ডট কম’ নামে এক ই-কমার্স ওয়েবপোর্টাল তৈরি করি কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য। বর্তমানে প্রায় ২৭টি জেলায় এর আউটলেট হয়েছে। অচিরেই ৬৪ জেলায় এর আউটলেট করতে পারব বলে আশা করছি। 

২০১৮ সালে গ্রামের অসহায়, গরীব অসহায় স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য গড়ে তুলি রিয়েল বুটিক হাউজ, যেখানে চারশ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। নিজস্ব ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে রিয়াল অ্যাগ্রোর সব পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। রিয়েল ট্রান্সপোর্টে এখন ৪ জন  কাজ করছেন।

ঢাকা পোস্ট : আগে আশপাশের যারা সমালোচনা করতেন, এখন তারা কী বলেন?

জিয়াউল হক : আমার প্রতি এলাকাবাসীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এসেছে। নিন্দুকের মুখে কোনো আওয়াজ নেই। অপপ্রচারকারীরা আজ বাকহীন। ডিজিটাল সেন্টারে সেবা দিয়ে এমনটি সম্ভব হয়েছে। দেশি বিদেশি অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমার ডিজিটাল সেন্টার নিয়মিত পরিদর্শন করতে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সুখী-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন না দেখতেন, তাহলে আমার বর্তমান পরিচয় হতো না।

বর্তমানে ইউনিয়ন ও পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টার থেকে তিনশর বেশি সেবা দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত সরকারি ৮২৭টি নাগরিক সেবা ডিজিটাইজেশনের আওতায় এসেছে। আরও ৯৮৫টি সেবা ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনার কার্যক্রম চলছে, যা ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা ছিল। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দেশে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এমন অনেক উদ্যোগ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান, বাকিগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে।

এএসএস/আরএইচ