রাজধানীর পান্থপথে ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির খাঁনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় ঘাতক ডাম্প ট্রাকচালক হানিফের ছিল না কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কোনো পেশাদার চালকও নন। তিনি ডিএনসিসির গাড়ি মেরামত ওয়ার্কশপে মূল মেকানিকের সহযোগী হিসেবে ৬/৭ বছর ধরে কর্মরত।

অথচ অবৈধভাবে গত তিন বছর যাবত তিনি সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারি যানবাহন চালাতেন। সর্বশেষ গত এক বছর যাবত তিনি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছিলেন।

ডিএনসিসির গাড়ি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনের সঙ্গে সখ্যতার সুবাদে তালিকাভুক্ত কর্মচারী বা চালক না হয়েও ময়লাবাহী ভারি ডাম্প ট্রাকটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। যা চালানোর জন্য তার নেই পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স।

শনিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গত ২৪ ও ২৫ নভেম্বর রাজধানীতে ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় দুজন নিহত হন। গত ২৪ নভেম্বর (বুধবার) গুলিস্তান এলাকায় নটরডেম কলেজের ছাত্র নাঈম খান ময়লাবাহী গাড়ি চাপায় নিহত হন। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ওই শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকের মূল চালক হারুনকে গত ২৬ নভেম্বর আটক করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল।

অন্যদিকে গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির খাঁন (৪৬) পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে ময়লাবাহী আরেকটি গাড়ির চাপায় নিহত হন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আহসান কবির খাঁন গত ২৫ নভেম্বর তার মগবাজারের বাসা থেকে মিরপুরের কর্মস্থলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের একটি মোটরসাইকেল করে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে সোনারগাঁ মোড় থেকে পান্থপথে যাওয়ার রাস্তার সিগন্যালে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে ডিএনসিসির একটি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক (পরীক্ষাধীন নম্বর : ৫১২৮) সেখানে অপেক্ষা করছিল। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই আহসান কবির খাঁনের মোটরসাইকেল ধাক্কা খেলে তিনি মাটিতে ছিটকে পড়েন। ময়লাবাহী গাড়ির চালক গাড়িটি না থামিয়ে তার ওপর দিয়েই চলে যায়। এ সময় অন্যান্য মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় লোকজন গাড়িটিকে ধাওয়া দিলে, ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকটি গ্রিনরোড সিগন্যাল পর্যন্ত গিয়ে চালক ও তার সহকারী গাড়িটি রেখে পালিয়ে যায়।

উপস্থিত পথচারীরা আহসান কবিরকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার কাছ থেকে পাওয়া পরিচয়পত্র থেকে তাকে শনাক্ত করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাদিরা পারভীন বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং- ৩৩।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত আহসান কবির খাঁন দৈনিক সংবাদে কর্মরত ছিলেন। ইতোপূর্বে তিনি প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছেন। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে।

র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সময় ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকের চালক মো. হানিফ ওরফে ফটিককে (২৩) গ্রেফতার করা হয়। তার বাড়ি কুমিল্লার সিটিপল্লী-১৪ মধ্য বস্তিতে। বাবার নাম কামাল মিয়া। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হানিফ দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে।

গ্রেফতার হানিফকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গত ২৫ নভেম্বর কারওয়ান বাজার থেকে গাবতলীতে ময়লা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। সকালে দুবার ময়লা নিয়ে গিয়েছিল। ময়লা নিয়ে তৃতীয়বার যাওয়ার সময় ময়লাবাহী ট্রাক দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীকে চাপা দেয়। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন তাকে ধাওয়া করলে সে কৌশলে গাড়ি থেকে নেমে লোকাল বাসে করে গাবতলীতে চলে যায়। গাবতলী থেকে ওই দিনই সদরঘাট হয়ে লঞ্চে করে হাইমচরে আত্মগোপন করে।

গ্রেফতার হানিফ আরও জানায়, সে প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়ি মেরামত ওয়ার্কশপে মূল মেকানিকের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। গাড়ি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই/একজন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতার সুবাদে প্রায় ৬/৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাতেন।

কর্মকর্তার যোগসাজশে মেকানিক থেকে ড্রাইভার হানিফ

গত তিন বছর ধরে তিনি সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারি যানবাহন চালাতেন। সর্বশেষ গত এক বছর যাবত সে ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছিলেন। সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত কর্মচারী বা চালক না হয়েও তিনি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকটি বরাদ্দ পান। এজন্য তাকে কোনো নির্দিষ্ট বেতন দেওয়া না হলেও, বকশিশ ও গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল বিক্রিই আয়ের উৎস বলে জানান।

পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই ঘাতক হানিফের

ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক একটি ভারি যানবাহন। যা চালানোর জন্য পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হলেও তার নামে হালকা যানবাহন চালানোর একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে বলে জানান হানিফ।

মূল চালককে খোঁজা হচ্ছে

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন বলেন, সরাসরি ঘাতক ময়লার ডাম্প গাড়িটি কার নামে বরাদ্দ, কে মূল চালক তা জানে না গ্রেফতার হানিফ। তবে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের জানতে পেরেছি মূল চালকের তথ্য পেয়েছি। সেটি আমরা ডিএনসিসিকে জানাব। তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।

অপর প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব গণমাধ্যম প্রধান বলেন, নটেরডেম ছাত্র নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার হারুন ছিলেন পরিচ্ছন্নকর্মী। তার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। মূল চালক ছাড়াই সে দেড় বছর ধরে চালক হিসেবে গাড়িটি চালাচ্ছিল। আর ঘটনার দিন গাড়ি চালাচ্ছিল সহকারী রাসেল। তারা চালকে হিসেবে বেতন পেতেন না। বকশিশ ও তেল চুরিই তাদের মজুরি। তারা ১৭ থেকে ২০ লিটার তেল বাঁচিয়ে মজুরি বা বেতন হিসেবে তুলে নিতেন। গাড়ি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হারুন আত্মগোপনে চলে যায়। পরে হারুনকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়।

সহযোগী রাসেলও দুই-তিনজন ডিএসসিসির কর্মকর্তার যোগসাজশে ট্রাক চালাচ্ছিল। তিনিও চুরি করা তেল বিক্রি করতেন। রাসেলকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

আর পান্থপথে গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির নিহতের ঘটনায় জড়িত গ্রেফতার হানিফও পেশাদার চালক নন। গ্রেফতার হানিফের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/ওএফ