‘বাবা পরীক্ষা কিন্তু শেষ, রেজাল্টের পর আমারে কিন্তু ভালো একটা কলেজে ভর্তি করাইতে হইব।’ সোমবার (২৯ নভেম্বর) সকালে বাবা আব্দুর রহমান ভাণ্ডারীকে এ কথা বলেছিলেন সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া ছেলে মাইনুদ্দিন। ভালো কলেজে ভর্তিসহ মাইনুদ্দিনকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন পিষ্ট হলো অনাবিল বাসের চাপায়। মাইনুদ্দিনের নিথর দেহ এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।

সোমবার মধ্যরাতে পূর্ব রামপুরার বাসায় ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের সঙ্গে আপ্লুত কণ্ঠে কথা বলছিলেন আব্দুর রহমান। পেশায় তিনি চা বিক্রেতা।

আব্দুর রহমান বলেন, সকালে ওয় যখন আমাকে ভালো কলেজের ভর্তির কথা কইলো তখন আমি কইলাম, ‘অবশ্যই বাবা, তরে ভালো কলেজে ভর্তি করুম। দশ ঘর ভাইঙ্গা (সম্পদ বিক্রি করে) হইলেও আমি তরে ভালো কলেজে ভর্তি করুম। তুমি ভালো মতো পড়বা। ভালোভাবে চলাফেরা করবা।’

‘রাতে হঠাৎ বাইরে থাইকা একজন আইসা বলল, ভাই তাড়াতাড়ি বাইর হন, ওর (মাইনুদ্দিন) অবস্থা ভালা না। এরপর গিয়া দেখলাম ওয় নাই। আল্লাহ। ও আল্লাহ রে আমার পোলাটারে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। আল্লাহ, তুমি ফিরাও ওরে,’ বলছিলেন বাবা।

এদিকে এখনও মাইনুদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়নি তার মা রাশেদা বেগমকে। তাকে বলা হয়েছে মাইনুদ্দিনের শরীর ভালো নয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছে।

তবে ছেলে হারানোর বিষয়টি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছেন মা। বাড়িতে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘এখন কেন আমার পোলারে ঢাকা মেডিকেল নিয়া যাইব? আমি সব বুঝি, টিভি ছাড় আমি দেখমু আমার পোলা কই।’

ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথোপকথন নিয়ে তিনি বলেন, রাতে সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায় মাইনুদ্দিন। যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে পাঁচ টাকা নেয় বুট খাবে বলে।

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাইনুদ্দিন ছোট। এক বোন বাক প্রতিবন্ধী। আর বড় ভাই বনশ্রীতে একটি ব্যক্তি মালিকানার গাড়ির চালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

এর আগে সোমবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় গ্রিন অনাবিল পরিবহনের বাসের চাপায় মাইনুদ্দিন নিহত হয়। এ ঘটনায় সড়ক অবরোধ করে উত্তেজিত জনতা। এ সময় ঘাতক বাসসহ আটটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় আরও চারটি বাস।

দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ বলেন, ঘটনার পর চালক পালিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাকে আটক করে। সে বর্তমানে থানায় আছে। বাসটিও জব্দ করা হয়েছে।

এ ঘটনার জেরে আটটি বাসে আগুন দেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, আমরা যতদূর জানি উত্তেজিত জনতা আগুন ধরিয়েছে। তবে সুযোগ সন্ধানী কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আগুন দিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।

তিনি বলেন, আমরা নিহতের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও বলেছেন তারা ভাঙচুর বা আগুন দেননি। অন্য কেউ এসে এসব করিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়।

প্রত্যক্ষদর্শী রাকিব জানান, আমরা চার-পাঁচ জন রামপুরার ওই সড়কের পাশেই ছিলাম। দেখলাম, রাইদা পরিবহনের একটি বাস রামপুরা থেকে মালিবাগের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি ছেলে রাইদা বাসে ওঠার চেষ্টা করে। বাসে ওঠার পর কোনো কারণে সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাঁ পাশ দিয়ে বেপরোয়া গতিতে অনাবিল পরিবহনের একটি বাস যাচ্ছিল। বাসটি ওই ছেলেকে চাপা দেয়। এরপর আমরা বন্ধুরাসহ ২০-২২ জন বাসটিকে রামপুরা থেকে মালিবাগের দিকে ধাওয়া করি। প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর আমরা বাসটি আটকে দিই। পরে জানালা দিয়ে চালক ও দরজা দিয়ে হেলপার পালিয়ে যায়।

রাকিব বলেন, ছেলেটিকে চাপা দেওয়ার সময় রাইদা ও অনাবিল উভয় বাসই বেপরোয়া ছিল। মনে হচ্ছিল তারা প্রতিযোগিতা করে বাস চালাচ্ছে।

এমএসি/এআর/এসএসএইচ