ভূমি অফিস মানেই যেন দালালের আখড়া। সেবাগ্রহীতাদের অনেকে যেতে পারেন না সহকারী কমিশনার (ভূমি) পর্যন্ত। কারণ, সর্বত্র দালালদের অপতৎপরতা। একেকটি রেকর্ড খুঁজে বের করতেই চলে যায় দিনের পর দিন।

এসব ধারণা থেকে জনগণকে বের করে নিয়ে আসতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ভূমিসেবা সহজীকরণ ও হয়রানিমুক্ত করতে পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাইজ করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে রাজশাহীর পবা ভূমি অফিসের কথা।

সেখানে সেবা দেওয়ার ধরনই যেন আলাদা। সেবাপ্রার্থীরা মেশিনে নিজের ফোন নম্বর  ও নামজারির নম্বর দিয়ে সেবার সর্বশেষ অবস্থা জেনে নিতে পারছেন। এছাড়া, সশরীরে অফিসে না এসেও অনলাইনে জমা দিতে পারছেন জমির খাজনা। অনলাইনে জেনে নিতে পারছেন তথ্য। জমা দিতে পারছেন সেবার জন্য নির্ধারিত ফি। ফলে ভোগান্তি দূর হয়ে গেছে। পবা ভূমি অফিসের ডিজিটাল সেবা এখন দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন পবা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহাদত হোসেন বিশেষ এক উদ্যোগ নেন। অফিসের নিচে সেবাপ্রার্থীদের বসার জন্য একটি ছাউনি নির্মাণ করেন; নাম দেন ‘মাটির মায়া’। ছাউনিতলায় বসে তিনি শোনেন সেবাপ্রার্থীদের সমস্যার কথা। যেসব সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া সম্ভব, সেগুলোর সমাধান সেখানে বসেই দিয়ে দেন।

পবার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেওয়া ‘মাটির মায়া’ উদ্যোগটি এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার এ উদ্যোগে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। সহকারী কমিশনাররা সেবাপ্রার্থীদের সমস্যা সরাসরি শোনায় ভূমি অফিসে কমেছে দালালের দৌরাত্ম্য। সেবাপ্রার্থীরা একটি অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসে এ সংক্রান্ত সেবা নিতে পারছেন।

বর্তমানে সারাদেশে সব ভূমি অফিসে ডিজিটাল ভূমিসেবা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমিসেবা দিতে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্প চালু করেছে।

পবা ভূমি অফিসে কথা হয় কয়েকজন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে। রমজান আলী বলেন, জীবনে অনেকবার জমির খাজনা দিয়েছি, নামজারি করেছি, খারিজ করেছি। আগে এগুলো খুব ঝামেলার কাজ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এখানে আমরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাজ করতে পারি। এখানে এলে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

‘আগে ভূমি অফিসে এসে যেকোনো কাজ করতে মানুষ ভয় পেত। কিন্তু বর্তমান সরকারের ভূমিবিষয়ক ডিজিটাল সেবার কারণে সহজ উপায়ে কাজগুলো করা যাচ্ছে। যেখানে কোনো ঝামেলা নেই, নেই ভোগান্তি। ঘুষ না দিয়েও যে ভূমি অফিসের সব কাজ করা যায়, এখন তা স্পষ্ট হয়েছে।’

সুজন আলী নামের আরেকজন বলেন, আমি বাবার সঙ্গে এখানে এসেছি জমি খারিজ করতে। প্রথমে অনলাইনে আবেদন করি, পরে ভূমি অফিসে এসে ফি দিই। কোনো হয়রানি ছাড়াই আমার কাজ হয়ে গেছে। আগে ভূমি অফিস মানেই ছিল দালালের আখড়া। কিন্তু এখন কোনো কাজ করতে আর দালাল লাগে না, লাগে না ঘুষও।

রাজশাহীর পবা উপজেলা ভূমি অফিসের ডিজিটাইজেশনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ এহসান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে মানুষ ঘরে বসে ভূমির খাজনা দিতে পারে, পরিমাণও দেখতে পারে। আমরা এটি ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে সরকার এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয়। এ উদ্যোগের জন্য আমাদের অফিস জনপ্রশাসন পদকে ভূষিত হয়।

তিনি বলেন, অনলাইনে ভূমিসেবা শুরু হয়েছিল রাজশাহীর পবা থেকে। ২০১৫ সালে ‘মাটির মায়া’ নামে এখানে একটি শেড করা হয়। সেখানে সাধারণ মানুষের কাতারে বসে তৎকালীন এসিল্যান্ড গণশুনানি শুরু করেন। তখন এটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সারাদেশে এটি অনুসরণ করতে বলা হয়। সেই থেকে আমাদের এ কার্যক্রম চলমান।

সহকারী কমিশনার বলেন, ২০১৭ সালে আমরা একটি অ্যাপ তৈরি করি যার নাম ‘ই-ল্যান্ড অফিস’। এর মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে হলেও আমরা সরকারকে দেখাতে সক্ষম হই যে ভূমির খাজনার পরিমাণ অনলাইনেই জেনে নেওয়া এবং অনলাইনেই পরিশোধ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে সারাদেশে অনলাইনে ভূমির খাজনা দেওয়ার যে ব্যবস্থা সেটি এখান থেকেই শুরু হয়। এখন সশরীরে না এসেও অনলাইনে খাজনা দেওয়া যায়। আমরা প্রায় ৪৪ হাজার নামজারি অনলাইনে করতে সক্ষম হয়েছি।

নামজারি নিয়ে শেখ এহসান উদ্দিন আরও বলেন, আমাদের এখানে মেশিনের মাধ্যমে সেবাপ্রার্থীরা নিজেই নিজের জমির নামজারির ফাইলটির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন।  ফাইলটি কোন টেবিলে আছে, তা ট্র্যাক করার ব্যবস্থা শুধুমাত্র এ ভূমি অফিসেই আছে। এছাড়া আমাদের এখানে হটলাইন নম্বরেরও ব্যবস্থা আছে।

তিনি বলেন, এখানে নাগরিক কর্নার নামক একটি অংশ রয়েছে।  ভূমি অফিসে কীভাবে সেবা নিতে হয়, কোন সেবায় কত টাকা ফি, নাগরিক কর্নারে এসব তথ্য দেওয়ালে টানানো রয়েছে। এ কর্নারে রয়েছে একটি সততা বক্স। পাশাপাশি এখানে মুজিব কর্নার আছে, আছে সার্ভিস কর্নার। এখানে আমরা একটি বই রেখেছি, যা থেকে ভূমি অফিসের ২৬ ধরনের সেবা সম্পর্কে জানা যাবে। যাদের জমি আছে, তাদের সবার ডাটা আমরা অনলাইনে এন্ট্রি করেছি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ভূমির ই-নামজারি সেবা উপজেলা ও সার্কেল মিলিয়ে ৪৮৭ স্থানে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া তিন হাজার ৬১৭ ইউনিয়নেও এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মোট আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার ৫০১টি। ডিজিটাল সেন্টার থেকে দেওয়া সেবার মধ্যে রয়েছে- জমির পর্চা উত্তোলন, অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান, ই-নামজারি আবেদন ও ফি প্রদান। এছাড়া অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন ও ফি জমাদান ইত্যাদি।

ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিক করে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সরকার কয়েক বছর আগে উদ্যোগ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুততার সঙ্গে সরকারের এ উদ্যোগ এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা ছিল। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এমন অনেক উদ্যোগ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান, বাকিগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে।

এএসএস/আরএইচ