এ সাইকেল নিয়েই প্রতিদিন কর্মস্থলে আসা যাওয়া করতেন কনস্টেবল মনির/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

আমরা তিন ভাই-বোন। আমাদের সবকিছুই বাবা দেখাশোনা করতেন। বাবা চলে গেলো। আমাদের এখন কে দেখবে? আমাদের পড়ালেখার কী হবে?

শনিবার (৪ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলছিলেন চট্টগ্রামে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত সিএমপির ট্রাফিক কনস্টেবল মো. মনির হোসেনের মেয়ে বিবি ফাতেমা।
 
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমার ছোট ভাই ফখরুল ইসলাম চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাবা এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি। বাবা ছাড়া দেখার মতো আমাদের কেউ নেই। এখন আমাদের পড়াশোনার কী হবে? বাসায় এসে কে আমাকে ফাতেমা বলে ডাক দেবে...? এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ফাতেমা। এ সময় স্বজনরা এসে তাকে সান্ত্বনা দেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, আমার বাবা যাদের অবহেলায় মারা গেলো তাদের বিচার চাই। 

শনিবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের জাকির হোসেন সড়কের ঝাউতলা এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পোর সঙ্গে ডেমু ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। এতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্য মো. মনির হোসেনসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।

মনির হোসেনের বড় মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস লিমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবা আমাদের অনেক ভালোবাসতেন। বাবা ছাড়া আমরা অসহায়। 

মনির হোসেনের স্ত্রী সেলিনা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের কী হবে এখন? সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাব, কী করব? তাদের দায়িত্ব কে নেবে এখন? 

চট্টগ্রাম নগরীর বনানী হাউজিং সোসাইটিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল মো. মনির হোসেন। মনির নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার খোয়াজপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

সিএমপি সূত্রে জানা যায়, কনস্টেবল মনিরুল হোসেন ১৯৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৮ জুন তিনি পুলিশে যোগদান করেন। সিএমপিতে যোগদান করেন ২০১৩ সালের ১৭ জুন। ট্রাফিক উত্তরে যোগদান করেন ২০১৯ সালের ৮ জুন।

দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের একটু দূরে পুলিশ বক্স। সেখানে খুঁটির পাশে একটা সাইকেলে তালা লাগানো। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, মনির হোসেন এ সাইকেল দিয়ে বাসা থেকে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতেন।  

এ সময় ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য দুঃখ করে বলেন, ‘আহা, সাইকেলটি এখানে পড়ে আছে, আর মনির ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে মর্গে।’

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) আলী হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মনির হোসেন দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তার প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন ডেমু ট্রেনটি আসে তখন রেলক্রসিংয়ের গেটবারটি ফেলা হয়নি। বারটি না ফেলায় দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা একটু এগিয়ে ছিল। এ সময় পেছনে একটি বাসও ছিল। বাসের চালক মনে করেছিলেন, যেহেতু গেটবারটি ফেলা হয়নি, ট্রেন আসার আগেই রেললাইন পার হওয়া যাবে। দ্রুত এসে বাসটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পোকে ধাক্কা দেয়। এতে অটোরিকশা ও টেম্পোটি রেললাইনের উপরে চলে যায়। ওই এলাকায় তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল মো, মনির হোসেন। রেললাইনের উপর অটোরিকশা দেখে বাঁচানোর জন্য দৌড়ে আসেন তিনি। ততক্ষণে ট্রেনও কাছে চলে আসে। এক পর্যায়ে ট্রেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পোকে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়ে যায়। এতে মনির হোসেন গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেওয়া বাসটি জব্দ করা হয়েছে।  

তিনি আরও জানান, এ ঘটনার পর থেকে রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান আলমগীর পলাতক রয়েছেন। ঘটনা তদন্তে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবং রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কেএম/এসকেডি/জেএস