বিশ্বের নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। প্রায়ই দেখা যায়, দেশটি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলে।

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কথা বলতে শোনা গেলেও এই প্রথমবারের মতো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে একটি ফোর্সের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার বিষয়টি ঢাকাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সঠিক তথ্য-উপাত্ত বা আলোচনা ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছে ঢাকা। কেন দেশটি এমন সিদ্ধান্ত নিল তার সঠিক কারণ জানতে চায় ঢাকা। তবে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ধরনের তিক্ততা চায় না বাংলাদেশ। বরং দেশটির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির ইতি টানতে চায়। শুধু তাই নয়, যদি এ নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির কারণে হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের পররাষ্ট্র নীতিতে অটল থাকবে ঢাকা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) শাব্বির আহমেদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলার বিষয়টি নতুন নয়। তবে এবার একেবারে নাম ধরে একটা প্রতিষ্ঠানের এতগুলো লোককে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। হঠাৎ করে কেন করল, এটাই আমাদের প্রশ্ন। তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত। আমরা তাদের প্রতিনিধিকে ডেকে উষ্মা প্রকাশ করেছি। এটা নিয়ে একেকজন একেক কথা বলবে, তবে আমরা চাই এর মূল কারণ জানতে। তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। আমরা চাই এ ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক। সম্পর্কে তিক্ততা আসুক সেরকম কিছু চাই না। আমরা সংলাপে বিশ্বাসী। সংলাপের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের সমস্যা সমাধান করতে চাই।

বাংলাদেশের ভারসাম্য কূটনীতি বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে এমনটা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এ সচিব বলেন, কেন হলো সেই উত্তর এখনই দেওয়া ঠিক হবে না। তবে আমরা বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতিকে ধারণ করেই সামনে এগোব। আমরা কারও সঙ্গে বৈরিতা চাই না।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। একই সঙ্গে তিনি দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন।

এ ছাড়া র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর শুক্রবার রাতেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করা হয়। ফোনে রাষ্ট্রদূতেক জানানো হয়, নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে সকালেই তাকে ডেকেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। ফোন পেয়ে সকালে পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে সাক্ষাতে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাষ্ট্রদূতের কাছে হতাশা, অসন্তোষ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত মিলার নিজেই বিস্মিত হয়েছেন বলে পররাষ্ট্রসচিবকে জানান। এরপর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে। সেখানে পররাষ্ট্রসচিবও উপস্থিত ছিলেন। ড. মোমেন তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন ঢালাও অভিযোগে উষ্মা প্রকাশ করেন ড. মোমেন।

এরপর দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্রসচিব রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় হতাশা, অসন্তোষ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্রসচিব দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রদূতকে বলেন, কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য র‍্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেটা শুধু (সংশ্লিষ্ট ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার জন্য) মার্কিন প্রশাসনের কাছে নয়, একাধিকবার জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থার কাছেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যে বিষয়গুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলো সক্রিয় আলোচনার অধীনে রয়েছে।

অস্বস্তিতে সরকার
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাত্র তিনদিন পরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশ যখন বিজয় দিবস উদযাপনে প্রস্তুত ঠিক তার কয়েকদিন আগেই তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্বস্তি তৈরি হয়। অবশ্য এরইমধ্যে তাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শুক্রবার তার বিদেশ যাওয়া নিয়ে যখন গণমাধ্যম সরব তার মধ্যেই খবর আসে র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। একসঙ্গে দুটো বার্নিং ইস্যু সরকারকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অনেক শীর্ষ নেতাই গণমাধ্যমে কথা বলছেন। মার্কিনিদের এমন সিদ্ধান্তে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গেছে। শুরুতে পররাষ্ট্রসচিবের মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব। তারপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ বিষয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সিস্টেমে কেউ ইচ্ছা করে ক্রসফায়ার বা গুলি করতে পারে না। ক্রসফায়ারের পেছনে যথাযথ কারণ আছে। এ সমস্ত ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশে এগুলো চলছে এবং চালু আছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর গণমাধ্যমে কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয় এবং অন্যদের ওপর তাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা একপেশে ও অকার্যকর।

সরকারের তিন শীর্ষ মন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিন (রোববার) এ বিষয়ে কথা বলেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা একপেশে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

একই দিন এ বিষয়ে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, এটা দুঃখজনক যে, কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় দফায় বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হয়েছে।

সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেলেন পররাষ্ট্রসচিব
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বর্তমানে তুরস্ক সফরে রয়েছেন। রোববার বেলা আড়াইটায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২১ উপলক্ষে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন, উপকৃত সব জনগণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। তিনি অবশ্য ভারত সফর শেষে তখনো দেশে পৌঁছাতে পারেননি। অনুষ্ঠানে তুরস্ক থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষ করেই বেরিয়ে পড়েন তিনি। সাধারণত কোনো বার্নিং ইস্যু থাকলে ফরমাল অনুষ্ঠান শেষে সরকারের মন্ত্রী বা আমলাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেন সাংবাদিকরা। অনুষ্ঠান থেকে পররাষ্ট্রসচিব বেরিয়ে গেলে সাংবাদিকরা তার পিছু নেন। কিন্তু তিনি কোনো কথা না বলেই চলে যান।

এনআই/এসএম/জেএস