১৯৯৭ ও ২০০৪ সালে দুই ধাপে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ‘সহকারী উপ-পরিদর্শক’ পদে (এএসআই) ৩৫ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর মাধ্যমে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যুরো থেকে কমিশন হওয়ার পর কোর্ট সহকারী (এএসআই) হিসেবে নিয়োগ পান তারা।
 
দীর্ঘ কর্মজীবনে পদের মর্যাদা ও জ্যেষ্ঠতার জটিলতা থেকে মুক্তি মেলেনি ওই ৩৫ কর্মকর্তার। এমনকি উচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পরও জট কাটেনি! ২০১৩ সালে পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও একটি মহলের ষড়যন্ত্র বা অবহেলায় আট বছর পর হয় রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন। অর্থাৎ পদোন্নতি হলেও মেলেনি জ্যেষ্ঠতা!
 
২০১৮ সালে সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের সঙ্গে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিলেও অন্তত ১০ বছরের জুনিয়রদের সঙ্গে তাদের (১৯৯৭ সালের এএসআই) বর্তমান অবস্থান! বহু বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আজ তারা জুনিয়রদের কাতারে। ফলে ভবিষ্যৎ পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন তারা।
 
‘আমি সিনিয়র’— এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই চাকরিজীবন শেষ করে ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন নয়জন। বাকি ২৬ সহকারী পরিদর্শক জ্যেষ্ঠতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। জ্যেষ্ঠতার দাবিতে তারা আবারও কমিশন চেয়ারম্যান, কমিশনার ও সচিব বরাবর আবেদন করেছেন।

জ্যেষ্ঠতা-বঞ্চিতরা ইতোমধ্যে লিখিত আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তাদের দাবি পর্যালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদোন্নতি-বঞ্চিত এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে আমাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১৮ সালে পদোন্নতি হলেও জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে জ্যেষ্ঠতা পাওয়ার আবেদন করলে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন আমাদের পক্ষে যায়। সেখানে জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার সুপারিশসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। ২০১৯ সালের ১৯ জুন সচিব অনুমোদন দিলেও দীর্ঘ আড়াই বছরে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
 
তিনি বলেন, ‘চলতি মাসে (ডিসেম্বর) দুদক মহাপরিচালক, সচিব ও দুই কমিশনার স্যারের সঙ্গে দেখা করে আমাদের কষ্টের কথা জানাই। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেন। তবে, আগের মতো এবারও আমাদের বঞ্চিত করার পায়তারা চলছে— অভিযোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
 
বঞ্চিতদের দাবির বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জ্যেষ্ঠতা-বঞ্চিতরা ইতোমধ্যে লিখিত আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তাদের দাবি পর্যালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
বঞ্চিতদের আবেদন ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে ২৪ জন এবং ২০০৪ সালে ১১ জন, মোট ৩৫ জন বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ‘সহকারী উপ-পরিদর্শক’ পদে যোগদান করেন। কমিশন গঠিত হওয়ায় তাদের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘কোর্ট সহকারী’ বা ‘সহকারী উপ-পরিদর্শক’ হিসেবে বহাল রাখা হয়। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকুরী বিধিমালা ২০০৮-এ সহকারী উপ-পরিদর্শকদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সাঁট মুদ্রাক্ষরিক/উচ্চমান সহকারী/সহকারীদের মধ্য থেকে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতির বিধান যোগ করা হয়। এছাড়া সহকারী উপ-পরিদর্শকদের সমস্কেল ও সমমর্যাদার উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতির বিধানও যোগ করা হয় বিধিমালায়। 
 
সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, সমস্কেল ও সমমর্যাদা পদে পদোন্নতির বিধান কীভাবে যুক্ত করা হলো? এরপর শুরু হয় আইনি লড়াই।


 
জ্যেষ্ঠতা-বঞ্চিত ওই ৩৫ সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (পিটিশন নং-৬৯০৮/২০০৯) দায়ের করেন। রিট পিটিশন মামলায় ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মরত কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের সঙ্গে একই পদভুক্ত করে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতির নির্দেশনা প্রদান করে রায় দেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের নির্দেশনাবলি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। যদিও পরবর্তীতে আর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অন্যান্য পদের সঙ্গে কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ‘কাগজপত্র প্রস্তুতপূর্বক ডিপিসিতে উপস্থাপন করুন’ এমন নির্দেশ দিলেও কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
 
একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নথিটি গোপন করে এএসআইদের পদোন্নতি বঞ্চিত করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে অনুমোদিত নথি গোপন করে নতুন স্মারকে নতুন নথি খুলে হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনের আদেশ অবমাননা করে ২০১৩ সালের ১৫ মে কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) বাদ দিয়ে সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিক হতে ৩১ জনকে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোর্ট সহকারীদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পদোন্নতি-বঞ্চিত কোর্ট সহকারীদের (এসআই) ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তুলনামূলক অনেক জুনিয়র সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের সঙ্গে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি দেওয়া হলেও ১০ বছরের জুনিয়রদের সঙ্গেই তাদের জ্যেষ্ঠতার হিসাব করা হয়।
 
বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, বঞ্চিতদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠতা প্রদানের বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় দুদকের তৎকালীন পরিচালক এস এম মাসুদুল হককে। সদস্য করা হয় উপপরিচালক কামরুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক আজিজুল হককে। ওই কমিটি ২ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিল করে।
 
প্রতিবেদনে দায়ী কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের তৎকালীন সচিব মুহাম্মদ দিলওয়ার বখত ২০১৯ সালের ১৯ জুন অনুমোদন প্রদান করেন এবং জ্যেষ্ঠতা প্রদানের জন্য প্রশাসন শাখা হতে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশনা দেন। কিন্তু প্রশাসন শাখা হতে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি বা কার্যক্রম গ্রহণ না করেই পুনরায় কমিটির নিকট নথিটি প্রেরণ করা হয়। সর্বশেষ জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন কমিটি চলতি বছরের ৮ নভেম্বর রেজুলেশনে সহকারী পরিদর্শকদের জ্যেষ্ঠতা প্রদান উক্ত কমিটির ‘এখতিয়ার বহির্ভূত’ এবং ‘বিষয়টি প্রশাসন শাখার দায়িত্ব’— এমন মতামত দিয়ে নথিটি পুনরায় সচিব বরাবর পাঠায়। এরপর তা আর সামনে এগোয়নি বলে জানা যায়।
 
বর্তমানে কর্মরত জ্যেষ্ঠতা-বঞ্চিত ২৬ সহকারী পরিদর্শক হলেন- মো. আব্দুল মোত্তালিব সরকার, মো. নুরুল ইসলাম, মো. মোফাজ্জল হায়দার, মো. মিজানুর রহমান, মো. হুমায়ুন করিব, আব্দুল লতিফ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. ওবায়দুল্লাহ ইবনে খালেক, মো. জোনাব আলী বেপারী, অধীর চন্দ্র নাথ, কাজী মাহমুদ হোসেন, আবদুল আউয়াল মোহাম্মাদ জুলফিকার, মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. রেজাউল করিম, মারুফা হাসান, কৃষ্ণপদ বিশ্বাস, মো. বাসেদ আলী, মো. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, আবু মোহাম্মদ আনোয়ারুল মাসুদ, মো. মনিরুজ্জামান, মো. জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ শাহজালাল।
 
দুদক বিধিমালায় যা বলা হয়েছে
 
দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকুরী-বিধিমালা, ২০০৮ এর ১১ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, “বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর যে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে যাচাই-বাছাই করিয়া কমিশনের চাকুরীতে বহাল রাখা হয়েছে এবং পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে তাদের চাকুরীর ধারাবাহিকতা বজায় থাকিবে এবং পদোন্নতি, সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল, পেনশন ও গ্রাচুইটি ইত্যাদি গণনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যুরোর কর্মকাল কমিশনের কর্মকাল হিসেবে গণ্য হবে এবং এই সকল ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগ বা সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হইতে সময় সময় জারিকৃত এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রজ্ঞাপনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
 
অন্যদিকে, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা ২০১১-এর ৭ (১) (ক) ধারায় বলা হয়েছে, “পদোন্নতির যোগ্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অসাবধানতাবশত প্রথমবারের বিবেচনা হতে বাদ পড়েন বা অতিক্রান্ত হন, তা হলে তিনি পরবর্তী পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন এবং তার জ্যেষ্ঠতা মূল ব্যাচের সহিত সংরক্ষিত হবে।”
 
আরএম/এমএআর/