চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার মাঝিরঘাট এলাকায় হেলে পড়া ভবন দুটি নির্মাণের অনুমতি ছিল না। খাল থেকে ১৫ ফুট দূরে বাড়ি করার কথা থাকলেও ভবন মালিকরা তা মানেননি বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। আপাতত হেলে পড়া ভবনগুলো সিলগালা করে দেওয়া হবে এবং পরবর্তীতে ভেঙে ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএর কর্মকর্তারা।

হেলে পড়া ভবনের মালিকরা অবশ্য বলছেন, সিডিএর অনুমতি নিয়েই নিজস্ব জায়গায় ভবন তৈরি করেছেন তারা। তাদের দাবি, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় খাল খননের কাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ভবন দুটি হেলে পড়েছে। ভবন হেলে পড়ার পর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথোরাইজড অফিসার মো. হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে দুটি ভবন ও একটি মন্দির হেলে পড়েছে। ভবন দুটি সিডিএর অনুমোদিত নয়। এছাড়া তিনতলা বিল্ডিংটির ফাউন্ডেশন মজবুত ছিল না। যে কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এমনকি ভবনটি পুরোপুরি নিজেদের ডিজাইন মেনেও করা হয়নি। খালের কাজ করার সময় সামান্য কম্পনেই ভবনটি হেলে পেড়েছে।

ভবন মালিকরা দাবি করেছেন সিডিএর অনুমতি আছে— এ প্রসঙ্গে মো. হাসান বলেন, ভবন মালিকরা দাবি করলেও এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আমাদের তারা দেখাতে পারেনি। এছাড়া খালের যে এলাইনমেন্ট আছে সেখান থেকে কমপক্ষে ১৫ ফুট দূরে বাড়ি করার কথা। কিন্তু তা মেনে ভবন দুটি করা হয়নি।

ভবন মালিকদের পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তো তাদের নিজস্ব জায়গা। সিডিএ তো খালের জায়গায় খাল খনন করে যাবে। যার বাড়ি তারই থাকবে। সুতরাং কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না।

সিডিএর এ কর্মকর্তা বলেন, ভবনগুলো এখন আমরা সম্পূর্ণ সিলগালা করে দেব। এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানাব। তারা পরে হেলে পড়া ভবনগুলো ভেঙে দেবে।

সরেজমিনে মাঝিরঘাট এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, স্ট্যান্ড রোড পার্বতী ফকির পাড়া এলাকার গোলজার খালের পাড়ে ভবনগুলোর অবস্থান। হেলে পড়া তিনতলা ভবনটি স্বপন বাবুর এবং দোতলা ভবনটি মনোরঞ্জন দাসের। তিনতলা ভবনটি কমপক্ষে এক ফুট খালের দিকে হেলে পেড়েছে। দোতলা ভবনটিও আংশিক হেলে পড়েছে। এ ভবনটির নিচে ফাটল দেখা গেছে। এছাড়া শ্রী শ্রী বিষ্ণু ও জগন্নাথ মন্দির হেলে পড়েছে। মন্দিরটির সামনের নিচের অংশে ফাটল ধরেছে। এর পাশে একতলা ঘরের মাটিতেও ফাটল ধরেছে। কথা বলে জানা গেছে, হেলে পড়া ভবন দুটিতে ৮টির মতো পরিবার থাকত। পরিবারগুলোর অন্তত ৪০ জন সদস্য আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

মনোরঞ্জন দাশের ছেলে শ্যামল দাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ শুরুর পর তারা যতটুকু চিহ্নিত করে দিয়েছিল, আমরা ততটুকু ভেঙে ফেলেছি। এখন যে খাল খনন চলছে তাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যারা কাজ করছেন তাদের বারবার অভিযোগ দিয়েছি কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শোনেননি। তারা উল্টো আমাদের ভয় দেখিয়েছে। ঠিকমতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম না। সোমবার থেকে বেশি ফাটল দেখা দিয়েছে। এখন তো বিল্ডিংগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে হবে। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই।

শম্ভু দাস নামে একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাঁচা ঘরের মাটিতেও ফাটল দেখা দিয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খাল খনন চলছে, তার কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত তিনতলা ভবনের বাসিন্দা রনি দাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খালে পাইলিংয়ের কাজ চলছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের ভবনটি নতুন। পর্যাপ্ত সেফটি না থাকার কারণেই কাজ করার সময় আমাদের ভবনটি হেলে পড়েছে। আমাদের ভবনের জায়গার কাগজপত্র আছে। ৪০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করে দুই বছর আগে ভবনটি তৈরি করেছি। এখনো অনেক আত্মীয়-স্বজন টাকা পাবে। আমরা ও চাচারা মিলে চারটি পরিবার বাস করতাম। হেলে পড়ার পর স্বজনদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

আরতি দাশ নামের একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিজের জায়গায় অনেক শখ করে বিল্ডিংটি করেছি। এখন তাদের কাজের কারণে ভবনটি হেলে পেড়েছে। আমরা এখন কোথায় যাব, কী করব বুঝতে পারছি না।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনতলা যে ভবনটি হেলে পড়েছে তার অংশবিশেষ আগেই উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ভবন মালিকদের আগেই বলা হয়েছিল আপনারা অনুমতিবিহীন, ফাউন্ডেশন ছাড়া বিল্ডিং করেছেন। যখন আমরা খাল খননের কাজে যাব, তখন ভবনগুলো হেলে পড়তে পারে বলে তাদের সতর্ক করেছিলাম। ভবনগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেছিলাম কিন্তু তারা সরিয়ে নেয়নি।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, খালের পাড়ে আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের ভেতরের কোনো মাটি যেন খালে না আসতে পারে, যাতে মাটির কোনো ধস না হয় তার জন্য আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিয়েই কাজ করছি। অন্য খালগুলোতেও আমরা একইভাবে নিরাপত্তা নিয়েছি। যেহেতু ভবনের অনুমতি নেই, ফাউন্ডেশন নেই, সে কারণেই ভবনগুলোর এ অবস্থা হয়েছে।

সোমবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে সদরঘাট থানার মাঝিরঘাট এলাকায় দুটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া যায়। সদরঘাট থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি তখন নিশ্চিত করেছিলেন। সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

এসএসএইচ/জেএস