জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের টাকায় সচিবের বাসায় চেয়ার-টেবিল-সোফা পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে / প্রতীকী ছবি

• পুরাতন একটি টেবিল ও চেয়ার দিয়েছে : সাবেক সচিব
• নিউজের বিষয়ে স্যারদের সঙ্গে কথা বলেন : বর্তমান সচিব
• আমি ঠিক মনে করতে পারছি না : প্রকল্প পরিচালক
• সচিব এভাবে কোনো কিছু নিতে পারেন না : টিআইবি
• সচিবের এভাবে কোনো কিছু নেওয়ার সুযোগ নেই : মন্ত্রী

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা- ২০২১’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর অনুমোদন দেওয়া হয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী চলতি বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী সারাদেশে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের হানায় এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনায় আজ অবধি মূল শুমারির কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে, প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের ব্যাপারে ব্যাপক তৎপরতা দেখায় কর্তৃপক্ষ!

শুধু ব্যয়ই নয়, ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের অর্থে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সদ্য সাবেক হওয়া সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর বাসায় চেয়ার, টেবিল ও সোফাসহ বেশকিছু আসবাবপত্র সরবরাহ করে কর্তৃপক্ষ। সচিব নিজেই বাসায় আসবাবপত্র দেওয়ার কথা ঢাকা পোস্টের কাছে স্বীকার করলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সরাসরি তা অস্বীকার করছেন।

শুধু ব্যয়ই নয়, ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের অর্থে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সদ্য সাবেক হওয়া সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর বাসায় চেয়ার, টেবিল ও সোফাসহ বেশকিছু আসবাবপত্র সরবরাহ করে কর্তৃপক্ষ। সচিব নিজেই বাসায় আসবাবপত্র দেওয়ার কথা ঢাকা পোস্টের কাছে স্বীকার করলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সরাসরি তা অস্বীকার করছেন

জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে আসবাবপত্র চেয়ে ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী সচিব সৌমিত্র কুমার পালের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠির অনুলিপি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন), সচিবের একান্ত সচিব ও স্টোর ইনচার্জের কাছেও সরবরাহ করা হয়। চিঠির একটি কপি ঢাকা পোস্টের কাছেও সংরক্ষিত আছে।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা- ২০২১’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার / ছবি- সংগৃহীত

সৌমিত্র কুমার পালের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মহোদয়ের সরকারি আবাসিক ভবনে দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করার জন্য নিম্নবর্ণিত অসবাবপত্রের প্রয়োজন। ক. সোফা ২ আসনের ২ সেট, খ. সোফা ১ আসনের ২ সেট, গ. সেক্রেটারিয়েট টেবিল (ছোট আকারে) ১টি, ঘ. রিবলবিং কাঠের চেয়ার ১টি, ঙ. সাইড টেবিল ১টি এবং চ. সেন্টার টেবিল ১টি।’

বিবিএস’র অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে জানান, শুধু ওই আসবাবপত্রই নয়, সাবেক সচিবের বাসায় একটি পরিসংখ্যান কর্নারও করে দিয়েছে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। যেখানে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী সচিব সৌমিত্র কুমার পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অফিশিয়ালি এ বিষয়ে কথা বলতে হলে স্যারদের অনুমতি প্রয়োজন। তাদের অনুমতি ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।’

কার অনুমতি প্রয়োজন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সচিব স্যারের অনুমোদন লাগবে। এছাড়া আমি এখন ওই দায়িত্বে নেই।’ আসবাবপত্রগুলো ফেরত আনা হয়েছে কি না— এ বিষয়ে সৌমিত্র কুমার পাল বলেন, ‘বলতে পারব না।’

শুধু চেয়ার-টেবিল-সোফা নয়, সচিবের বাসায় একটি পরিসংখ্যান কর্নারও করে দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ / প্রতীকী ছবি

প্রকল্প থেকে সচিবের বাসায় আসবাবপত্র সরবরাহের প্রসঙ্গ তুললে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কবির উদ্দিন আহাম্মদ উল্টো ঢাকা পোস্টের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনাকে কে বলল, এগুলো সচিবের বাসায় দিয়েছি? কোনো অবস্থাতেই এমনটি হওয়ার কথা নয়।’

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ চিঠির মাধ্যমে আপনার কাছে আসবাবপত্র চেয়েছিল— প্রসঙ্গটি তুললে কবির উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘এটা দেখতে হবে। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আসবাবপত্র দেওয়ার যে কথা বলছেন, সেগুলো যাওয়ার কথা নয়। আরও কিছু জানতে হলে আমাদের উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) লিজেন শাহ নঈমের সঙ্গে কথা বলেন।’

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কবির উদ্দিন আহাম্মদের কথা মতো জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) লিজেন শাহ নঈমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। তিনি বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের অন্য ডিপার্টমেন্ট দেখে। আমাকে কিছু বলতে হলে দেখে বলতে হবে।’

পরবর্তীতে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ফার্নিচার কেনা হয়। আপনি সঠিক কোন বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন?’ তাকে আবার সাবেক সচিবের বাসায় আসবাবপত্র দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া হয়। এবার লিজেন শাহ নঈম বলেন, ‘বাসায় তো কোনো ফার্নিচার দেওয়া হয়নি। বাসায় কেন ফার্নিচার দেওয়া হবে? সোফা, চেয়ার, টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র দেওয়ার তথ্য সঠিক নয়। এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমাদের কাছে আসল বা গেল, সেটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা প্রকল্পের অর্থে সচিবের বাসায় কোনো ধরনের কিছু দিইনি। হয়তো একটা চেয়ার-টেবিল দেওয়া হতে পারে। কিন্তু আপনি যেটা বলেছেন সেটা ভুল।’

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) মহাপরিচালককে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বর্তমান সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি কোনো নিউজের বিষয়ে কথা বলি না। আমাদের স্যাররা (মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী) তো আপনাদের সঙ্গে কথা বলেন। সব মিটিংয়ের পর স্যাররা সাংবাদিক সম্মেলন করেন। নিউজের ব্যাপারে আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’

আসলেই কি তৎকালীন সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর বাসায় কোনো আসবাবপত্র পাঠানো হয়েছিল— বিষয়টি নিশ্চিত হতে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব, বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে সহকারী সচিব সৌমিত্র কুমার পালের স্বাক্ষরিত চিঠি এবং পাঠানো আসবাবপত্রের তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, একটা টেবিল ও একটা চেয়ার দিয়েছিল। তবে সেগুলো পুরাতন ছিল। এর বাইরে সোফা বা অন্য কোনো আসবাবপত্র দেয়নি মনে হয়। ওই চেয়ার ও টেবিল আমি নিয়ে যেতে বলেছি।’

প্রকল্প বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনায় আজ অবধি মূল শুমারির কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি বলেও অভিযোগ আছে/ প্রতীকী ছবি

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা (সচিব) হিসেবে আপনারা সুযোগ-সুবিধা পাবেন, এটা স্বাভাবিক। এছাড়া কোভিডের সময় বাসা থেকে অফিস করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। সেক্ষেত্রে আসবাবপত্রের প্রয়োজন হতেই পারে। এক্ষেত্রে যেখানে নতুন আসবাবপত্রের তালিকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হলো সেখানে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ পুরাতন চেয়ার ও টেবিল সরবরাহ করল— বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? জবাবে সচিব ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, ‘এটা জানতে হবে। আসলে তারা কী করেছে? আমি খোঁজ নিয়ে দেখি… তারা কী করেছে?’

প্রকল্প থেকে কারও বাসায় এভাবে কোনো আসবাবপত্র সরবরাহ করা যায় কি না— জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্ট বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী কোনো সচিব প্রকল্প থেকে এভাবে কোনো কিছু নিতে পারেন না। যদি এমন কোনো বিষয় থাকে, যেমন- উনি যদি প্রকল্পের চার্জে থাকেন বা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত থাকেন, যেগুলো তার বাসায় থেকে সম্পন্ন করতে হয়, সেখানে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে তিনি নিতে পারেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বা প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সেগুলো ফেরত দেওয়ার নিয়ম।’

‘কোনো প্রকল্প থেকেই কোনো কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কাজে কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারেন না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাসায় বসে দাফতরিক কাজও করতে হয়। সেই কাজ করতে এ ধরনের আসবাবপত্রের সরাসরি প্রয়োজন আছে কি না, সেটা যাচাই-সাপেক্ষে সাময়িকভাবে নিতে পারেন। কিন্তু দায়িত্বপালন সম্পন্ন হওয়ার পর সেগুলো ফেরত দিতে হয়। যদি ফেরত না দেওয়া হয় তাহলে সেটা অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার। এর মাধ্যমে জনগণের সম্পদের অপব্যবহার করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্প থেকে সচিবের বাসায় কোনো আসবাবপত্র নেওয়ার সুযোগ নেই। সেটা অফিসের প্রয়োজনেই হোক। আর নিলেও যাওয়ার সময় তা ফেরত দিতে হবে।’

জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান / ছবি- সংগৃহীত

‘আমি নিজে মন্ত্রী হয়েও অনেক কিছু ভোগ করি। সেটা মন্ত্রী হওয়ার কারণে করতে হয়। মন্ত্রী না হলে তো করতাম না। আমি নিজেও স্বীকার করি, মহান আল্লাহর কাছে মাফও চাই। তবে, বাড়াবাড়ি ভালো নয়।’

প্রকল্পের টাকায় সচিবের বাসায় আসবাবপত্র পাঠানো কতটা যৌক্তিক— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। আমি খোঁজ নিব।’

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা- ২০২১’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এক হাজার ৭৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ১৮৩ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা।

একনেকে অনুমোদনের পর প্রকল্প আন্তঃসমন্বয়ে সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে ব্যয় কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৫৭৫ কোটি টাকায়। প্রকল্পটি আন্তঃসমন্বয়ের কারণে এবং আইসিআর পদ্ধতি বাদ দিয়ে ট্যাবের মাধ্যমে শুমারি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা তাদের অর্থ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এসআর/এমএআর/এমএইচএস