রাত তিনটা। সুগন্ধার অপেক্ষা কুয়াশায় ঢাকা শীতের ভোরের। কাঁথা মুড়ি দিয়ে অনেকে গভীর ঘুমের দেশে। কে জানে, স্বপ্ন তাদের কতটা রঙিন! জেগে থাকারা কুয়াশা ভেদ করা সোনালী রৌদ্দুর দেখার অপেক্ষায়। প্রিয়জনের মুখটাও নিশ্চয়ই ভেসে উঠছে কল্পনায়। ১০ ঘণ্টার যাত্রার শেষদিকে লঞ্চ, গন্তব্য তো খানিকটা দূর।

হঠাৎ বিকট শব্দ; চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। নদীর মাঝখানেই লঞ্চে আগুন! যতক্ষণে ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে অনেকের শরীর কঙ্কাল। ভোরের আলোয় ঝালকাঠির এমভি অভিযান লঞ্চের ডেকে হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখা গেল। চারদিকে কেবল পুড়ে যাওয়া লাশের গন্ধ।

কেউ লঞ্চের তিনতলা থেকে লাফিয়েছেন প্রাণে বাঁচতে। কারো সাঁতরাতে হয়েছে কোলে শিশু নিয়ে। রাত তিনটায় এমনিতেই অন্ধকার; তার ওপর কুয়াশা। খুব কাছেই নদীর তীর হলেও তা দেখা বড্ড দুরূহ সেসময়। এর মধ্যেই এক বাবা সাঁতরাচ্ছেন তার সন্তানকে কোলে নিয়ে।

এমন গল্প এমভি অভিযানে থাকা অনেকেরই। আট বছরের শিশু তাইফার অবশ্য ভোর দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। বাবার পাশে নির্ভার হয়ে ঘুমানো শিশুটিকে মরতে হয়েছে অঙ্গার হয়ে। বাবা বেঁচে গেলেও বাঁচাতে পারেননি মেয়েকে।  

৬৫ বছরের ময়ফুল বিবি ছিলেন ইঞ্জিন রুমের ঠিক পাশে। স্বামী হামিম হাওলাদার ও মেয়েও ছিলেন কাছেই। গভীর ঘুমে ছিলেন তিনজনই। বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ধোঁয়ায় শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এরপর উঠে যান লঞ্চের তিন তলায়। বাঁচতে একসঙ্গে লাফ দেন নদীতে।

দুঘণ্টা ভেসে থাকার পর হুঁশ ফেরে ময়ফুল বিবির। বুঝতে পারেন আছেন নিরাপদে। মেয়ের খোঁজ পেলেও এখনো স্বামীর দেখা পাননি। চোখ ছলছল করা ময়ফুলের চোখেমুখে আতঙ্ক আর ভয়—আর কখনো স্বামীর দেখা পাবেন কি না, কে জানে!

লঞ্চ তখন ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যেই এক নারী খুঁজছিলেন কিছু একটা। পুড়ে যাওয়া জুতা, কঙ্কাল আর লাশের গন্ধ ছাড়া যেখানে কিছু নেই, সেখানে কী খুঁজছেন? মধ্যবয়সী এ নারী জানালেন তার ৬৫ হাজার টাকা আছে এখানেই। টাকা পুড়ে যে গেছে, তা হয়তো বুঝতে পারছেন, কিন্তু মনটা তো মানতে চাইছে না!

১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরছিলেন মা। আগুন লাগার পর আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ক্লাস এইটে পড়া ছেলে যে সাঁতার জানে না; কোথায় যাবেন তাকে নিয়ে! নিজে বেঁচে থেকে যদি ছেলেকে মৃত দেখেন, তাহলে বেঁচে থেকেই বা কী লাভ হবে!

কিন্তু আর কোনো উপায়ও খোলা নেই সামনে। লাফ তো দিতেই হবে। ছেলেকে কোলে তুলে নিলেন। আর বললেন, ‘বাবা, আবার কেয়ামতের দিন দেখা হবে...পড়ার লাইগ্যা তোমাকে অনেক মারছি। মাফ কইরা দিও।’ ছেলে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে, ‘মা, তোমারে ছাড়া আমি বাঁচব না...’ বলে ভেঙে পড়ে কান্নায়।

আহ! কী আবেগঘন দৃশ্য! সৃষ্টিকর্তার দয়া হলো মা-ছেলের প্রতি। ভাসতে ভাসতে তারা নদীর কাছাকাছি চলে এলেন। এরপরই মা দেখতে পেলেন ভেসে যাচ্ছে গাছ। ছেলেকে বললেন, ‘বাবা, তুমি পানির নিচ দিয়া হাঁটবা। হাইট্টা দেখবা, গাছ পাইলে গাছ ধইরা উপরে উইঠা যাইতে পারবা।’

ঢাকার খিলগাঁওয়ে ব্যবসা করেন বরগুনার রাজু আহমেদ। তিনি এমভি অভিযানে ছিলেন দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে। মরেই যাবেন এমন ভাবনা ছিল তার। স্ত্রীর কোলে তুলে দেন ছেলেকে, নিজের কাঁধে তুলে নেন মেয়েকে। এরপর লাফ দেন লঞ্চের তিনতলা থেকে। কোনোভাবে বেঁচে ফেরেন সবাই।

এমন সৌভাগ্য অবশ্য হয়নি আমেনা বেগমের। আগুন লাগার সময় তিনি ছিলেন টয়লেটে। ওই লঞ্চে তার সঙ্গী ছিল চার স্বজন। টয়লেট থেকে বেরিয়ে জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন নদীতে। নিজে বাঁচলেও স্বজনরা কোথায়, জানেন না।

সুমন আহমেদের গল্পটা আরও বেশি যন্ত্রণার। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকায়। কিন্তু ধুলোর শহর ভালো লাগছিল না তার। তাই গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ঘর তৈরির কাজ শুরু করেন। সেটির কাজও শেষ হয়েছে প্রায়। ঢাকায় থাকা পরিবারকে চলে আসতে বলেন গ্রামে।

সুমনের স্ত্রী তাসলিমা বেগম, বড় মেয়ে সুমাইয়া আক্তার সীমা, ছোট মেয়ে তানিশা ও ছোট ছেলে জুনায়েদ চড়েছিলেন এমভি অভিযানে। কিন্তু বাড়িতে আর ফেরা হলো না। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও খোঁজ মেলেনি তাদের। সুমন আহমেদ শের–ই–বাংলা মেডিকেলে দাঁড়িয়ে তাই ভেজা চোখে চিৎকার করে বলেন, ‘কার সঙ্গে ঘরে থাকব?’

সুমন আহমেদের প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউ। এমভি অভিযান লঞ্চে পড়ে থাকা জুতা কিংবা কঙ্কালগুলো কার, জানা যাবে না তার উত্তরও। ওই নারী কি তার ৬৫ হাজার টাকা ফেরত পাবেন কোনোভাবে? সেটা না হয় তিনি পেলেন না। কিন্তু ময়ফুল বিবি বৃদ্ধ বয়সটা স্বামীকে ছাড়া কাটাবেন কীভাবে?

একটা ভোর অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। একটা ভোর দেখায় মৃত্যু আর বেঁচে থাকার তফাৎ। গল্প তৈরি করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের। তবুও নিশ্চয়ই সব জায়গায় প্রার্থনা একই থাকে। এমন ভোর কখনো আর না আসুক কোথাও। ‘আহারে জীবন...আহারে’ এ আফসোসও নিশ্চয়ই কণ্ঠে থাকে!

এমএইচ/আরএইচ